২০২০ সালের মার্চে ঢাকা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি (তৎকালীন) আরিফুল ইসলামকে চোখ বেঁধে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় সিনিয়র সহকারী সচিব (তৎকালীন আরডিসি) নাজিম উদ্দিন আলোচনায় উঠে আসেন। সেই ঘটনা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি আর তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে তখনকার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) আবু তাহের মো. মাসুদ রানার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন, আরডিসি নাজিম উদ্দিন ও সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এসএম রাহাতুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়।
পদাবনতির বিষয়ে নিজের “গুরুদণ্ড” মওকুফ করতে নাজিম উদ্দিন ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে পুনর্বিবেচনার আবেদন জানান। যার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি ওই শাস্তি বাতিল করেন।
আরও পড়ুন- কাবিখা’র টাকায় পুকুর সংস্কার করে ডিসি’র নামে নামকরণ!
পরবর্তীতে সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী (সিইও) হিসেবে নাজিম উদ্দিনের পদায়ন হয়। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাতক্ষীরা পৌর এলাকায় আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন তিনি। ঘুষ বাণিজ্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ, ক্রসফায়ারের হুমকি, নির্বাহী কোর্ট বসিয়ে জেল-জরিমানার হুমকি, চাকরি থেকে অব্যাহতির হুমকি থেকে শুরু করে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে মাদক সেবন ও বহনের অভিযোগ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে রয়েছে।
এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে অনলাইন গণমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন।
এমনকি তার বিরুদ্ধে রয়েছে পৌর মেয়রকে অপসারণ চক্রান্ত ও নিয়মবহির্ভূত ছুটি কাটানোর অভিযোগও। সব মিলিয়ে অধস্তন ও এলাকাবাসীর কাছে নাজিম উদ্দিন যেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক।
আরও পড়ুন- সাংবাদিক আরিফুলকে নির্যাতন: রাস্তা থেকে ধরে আনা হয় মিথ্যা মামলার সাক্ষী
এ বছরের ৪ জানুয়ারি সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী হিসেবে যোগ দেন নাজিম উদ্দিন। তারপর পৌরষভায় দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে কর্মরত কাজী বিরাজ হোসেনকে নাজিমের ব্যক্তিগত এবং প্রশাসনিক কাজ করতে আদেশ করা হয়। এরপর থেকে নাজিম উদ্দিনের “বিশ্বস্ত হাত” হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সাতক্ষীরা পৌরসভার নির্বাহী আদেশ পালন করে আসা বিরাজ।
পৌর কর্মচারীর সঙ্গে প্রতারণা ও ‘ক্রসফায়ারের’ হুমকি
পদায়নের পরই বিরাজের চাকরি স্থায়ী করে দেওয়ার মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে তার দিকে সহানুভূতির হাত এগিয়ে দেন নাজিম। প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে গত ২১-২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নাজিমকে সর্বমোট ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দেন বিরাজ। এমনকি ২৩ ফেব্রুয়ারি মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে আরও ৫ হাজার টাকা দেন বিরাজ।
পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টা ২২ মিনিটে নিজামকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৩০ হাজার টাকা, পরে ২৫ হাজার টাকা ও পুনরায় ১০ হাজার টাকা দেন বিরাজ। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সবগুলো লেনদেনই নাজিমের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে হয়েছে।
আরও পড়ুন- সাংবাদিক নির্যাতন: সাবেক ডিসি সুলতানাসহ জড়িতদের দ্রুত বিচার দাবি
এছাড়া, নাজিম উদ্দিনের কথা মতো ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ইসলামি ব্যাংকের কলারোয়া শাখার শাহিদা নামের একজনের হিসাবে ৫০ হাজার টাকা জমা দেন বিরাজ। গত ১০ মার্চও একই অনুরোধে এবি ব্যাংকের সাতক্ষীরা শাখায় মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান নামের একজনের হিসাবে ৯ হাজার টাকা জমা দেন তিনি।
বাংলা ট্রিবিউন আরও জানায়, বিরাজের মতোই চাকরি স্থায়ী করে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অফিস সহায়ক রুবেল ও রেজার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে মোট ১ লাখ টাকা নেন নাজিম।
আরও পড়ুন- নাজিম উদ্দিন প্রসঙ্গে রিন্টু বিকাশ: সিনিয়রদের কাজে বাধা দেওয়ার অধিকার নেই
যার মাধ্যমে নাজিম এ টাকা হাতিয়েছেন সেই বিরাজ জানান, নাজিম ভয়-ভীতি দেখানোর কারণেই বিষয়টি ওই দুজন গোপন রেখেছেন।
কিন্তু চাকরি তো স্থায়ী হয়ইনি, উল্টো গত ৬ এপ্রিল বিরাজকে ‘‘মাদক ব্যবসায়ী’’ অ্যাখ্যা দিয়ে চাকরিচ্যুত করেন নাজিম। ওইদিন আনুমানিক দুপুর ২টা থেকে ৩টার মধ্যে কাজী বিরাজকে ২১২ নম্বর কক্ষে ডেকে রুমের দরজা বন্ধ করে দেন নাজিম। এরপর অসৎ কার্যকলাপের প্রমাণ লুকাতে বিরাজের ফোন ছিনিয়ে নেন।
ওইদিন ২১২ নম্বর কক্ষে পৌরসভার বড়বাবু প্রশান্ত প্রসাদ ব্যানার্জী, তহমিনা খাতুন এবং অফিস সহায়ক কামাল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।
ঘটনার প্রসঙ্গে কাজী বিরাজ বলেন, “চাকরি স্থায়ী করার কথা বলে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন নাজিম উদ্দিন। যখন তার প্রতারণা বুঝতে পারি, তখন বলি, স্যার আমার সর্বনাশ করবেন না। আমি গরিব, টাকাটা ফেরত দিন। তখন তিনি আমাকে অফিসের সবার সামনে মাদক মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে আমাকে চাকরিচ্যুতও করেন।”
এমনকি চাকরি থেকে বহিষ্কারের পর নাজিম হত্যার হুমকি দেন বলেও অভিযোগ করেন বিরাজ। কেবল বিরাজের সঙ্গেই না, কথায় বনিবনা না হলে নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে অন্যান্য কর্মচারীদেরও গালিগালাজ ও “ক্রসফায়ার”-এ হত্যার হুমকি দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাজিম যেন গালিগালাজ আর “ক্রসফায়ার”-এর মন্ত্র জপেন
২০২০ সালের সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় প্রত্যাহার হওয়ার পর এক মৎস্যজীবিকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়েছিলেন নাজিম। সেই ক্রসফায়ারের হুমকি তিনি আজও দেন।
পৌরসভার পানি সরবরাহ শাখার কয়েকজন মাস্টাররোলের কর্মচারীর বরাতে বাংলা ট্রিবিউন জানায়, নাজিম উদ্দিন পানি সরবরাহ শাখার যে কাউকে তার অফিস রুমে ডেকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ ক্রসফায়ার ও জীবননাশের হুমকি দেন। তার এ আচরণে ভীত হয়েই এ শাখার কর্মচারীরা পৌর মেয়রের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে নাজিম এতে ক্ষুব্ধ হন।
আরও পড়ুন- আরিফুলকে 'কলেমা পড়িয়ে এনকাউন্টারে' দিতে চান সহকারী কমিশনার!
পানি সরবরাহ শাখার মো. আনারুল ইসলামকে নিজের রুমে ডেকে অসদাচরণ করেন বলে নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। গত ১৭ এপ্রিল একই শাখার আরেক কর্মকর্তা মো. আরিফুর রহমানকেও ডেকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও ক্রসফায়ারের হুমকি দেন তিনি।
এছাড়া, নিজের বিরুদ্ধে পৌর মেয়রের কাছে পানি সরবরাহ শাখার কর্মচারীদের লিখিত অভিযোগের কারণে ১৯ এপ্রিল ওই শাখার মো. আরিফুর রহমান, শেখ মোস্তাফিজুর রহমান ও আরিফ আহম্মেদ খানকেও রুমে ডেকে শাসিয়ে “আমার বিরুদ্ধে মেয়রের কাছে কী অভিযোগ দিয়েছ?” বলে প্রশ্ন করেন।
আরও পড়ুন- কুড়িগ্রামের সহকারী পুলিশ সুপার: আরিফুলকে ভালো মানুষ হিসেবে চিনি
এরপরই তিনি ওই তিন জনের ওপর চড়াও হয়ে হাজিরা খাতা এনে তাদের নাম কেটে বাতিল ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে তুই-তোকারি সম্বোধন করে পরদিন থেকে পৌরসভার গেটের ভেতরে ঢুকতে নিষেধ করে দেন। এ ঘটনার পর থেকেই ওই কর্মকর্তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
ক্রসফায়ার ছাড়াও কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত আর জেল জরিমানা করার হুমকিও দেন নাজিম। এমনকি নিজের কাছে কাউকে ২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতাও রয়েছে বলে দাবি করেন সাতক্ষীরা পৌরসভার সিইও।
মেয়রের বক্তব্য
সাতক্ষীরার পৌর মেয়র মো. তাজকিন আহমেদ বলেন, “আমি অবাক হয়েছি যে, আমার সঙ্গে সিইও নাজিম উদ্দিনের কোনো ব্যক্তিগত রেষারেষি ছিল না। তারপরও তিনি মন্ত্রণালয়ে আমার সম্পর্কে ১০ জন কাউন্সিলকে দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছেন। যদিও সেটা তদন্তাধীন। তবে দৃঢ়ভাবে বলছি, আরও ১০ বারও যদি আমার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়, তারপরও কোনো অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাবে না।”
তিনি আরও বলেন, “নাজিম উদ্দিনের কারণে বর্তমানে পৌর এলাকায় নাগরিক সেবা শতভাগ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। তিনি কর্মকর্তাদের হুমকি, জেল-জরিমানার ভয় দেখিয়ে জিম্মি করে রাখতে চাইছেন। বিধি অনুসারে, সব কাজের আগে সিইওকে মেয়রের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু তিনি আইনের তোয়াক্কা করেন না। চারপাশে ভীতিকর পরিস্থিত তৈরি করে রেখেছেন। তার খুব দম্ভ। সবার সামনে বলেন, তার নাকি কিছুই হবে না।”
আরও পড়ুন- এক সাংবাদিক ধরতে ৪০ জনের বাহিনী, হাইকোর্টের বিস্ময় প্রকাশ!
বাংলা ট্রিবিউন জানায়, এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে নাজিম উদ্দিনের মন্তব্য জানতে তার ব্যক্তিগত নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল কেটে দেন। পরে আবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
২০২০ সালের ১৩ মার্চ নিজ বাড়ি থেকে আরিফুল ইসলামকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে গভীর রাতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে “ভ্রাম্যমাণ আদালত” তাকে এক বছরের জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযোগ আনা হয়, আরিফুলের বাড়ি থেকে আধা বোতল মদ ও ১৫০ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে। যদিও আরিফুলের স্ত্রী ও স্থানীয়দের দাবি, আরিফুল মদ-গাঁজা তো দূরের থাক পানসেবী বা ধূমপায়ীও নয়।
প্রসঙ্গত, কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে নিজ নামে পুকুর খননের অভিযোগ ওঠায় সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন লেখেন আরিফুল। সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের নিয়োগ অনিয়ম নিয়েও প্রতিবেদন করছিলেন তিনি।