এমবিবিএস ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।
রবিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন এ ফলাফল ঘোষণা করেন। এবারের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ৪৯ হাজার ৯২৩ জন।
এবারের ভর্তি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়ে আলোচনায় এসেছেন বগুড়ার জমজ দুই ভাই। তবে আলোচনা শুধু দুই ভাইয়ের জন্য নয়; তাদের আরও এক জমজ সহোদরও গত বছর সরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
তিন ভাই হলেন- মাফিউল হাসান, সাফিউল হাসান ও রাফিউল হাসান। এদের মধ্যে মাফিউল ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। সেবার ভর্তি পরীক্ষা দিলেও অপর দুই ভাই সুযোগ পাননি। তবে তাতে তারা দমে যাননি, বরং পড়াশোনায় আরও বেশি পরিশ্রমী হয়ে ওঠেন। আর সেটির ফলও পেয়েছেন তারা। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন সাফিউল ও রাফিউল। সাফিউল দিনাজপুর মেডিকেলে কলেজ এবং রাফিউল হাসান নোয়াখালী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।
এই সাফল্যের পর তিন জমজ ভাই ভাসছেন প্রশংসার জোয়ারে। প্রশংসা পাচ্ছেন তাদের মা আর্জিনা বেগমও। কারণ, তিন সন্তানের এই সাফল্যের পেছনে তাদের মায়ের অবদান অসামান্য।
বগুড়ার ধুনট উপজেলা সদর ইউনিয়নের বথুয়াবাড়ি গ্রামের স্কুল শিক্ষক গোলাম মোস্তফা ও গৃহিণী আর্জিনা বেগম দম্পতির ঘরে গত ২০০৪ সালের ৩০ নভেম্বর তিন জমজ ভাইয়ের জন্ম হয়। এই দম্পতির আগে থেকেই ছিল আরও এক ছেলে ও এক মেয়ে। আর্জিনা বেগমের মূল সংগ্রাম শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। সে বছর হৃদরোগে মারা যান স্বামী গোলাম মোস্তফা। পাঁচ সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েন এই গৃহবধূ। তবে হাল ছাড়েননি, বরং আরও বেশি ভরসার ছায়া হয়ে ওঠেন সন্তানদের মাথায়। তাদের লেখাপড়ার জন্য বিক্রি করে দেন স্বামীর রেখে যাওয়া এবং নিজের বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া জমি। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তার পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
রত্নগর্ভা মা আর্জিনা বেগম ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “২০০৯ সালে ওদের বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন ওদের তিনজনের বয়স ৫ বছর। বাবার স্নেহ-মমতা কিছুই পায়নি ওরা। পাঁচ সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে বিপাকে পড়ি।”
ছেলেদের চিকিৎসক বানাতে নিজের শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে দেবেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সন্তানরা ডাক্তার হয়ে যাতে আমাদের মতো গরিব মানুষের সেবা করতে পারে সেই দোয়া করি।”
জমজ এই তিন ভাই পড়াশোনা করেছেন ধুনট নবির উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। তিন ছাত্রের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, “সোমবার তিন ভাই একসঙ্গে স্কুলে আসে। শিক্ষকদের কাছ থেকে দোয়া চায়। আমরা তাদের জন্য দোয়া করি। তারা মিষ্টি নিয়ে এসেছিল। ওদের মেডিকেলে সুযোগ পাওয়া আমাদের স্কুলের জন্য গৌরব ও সুনামের। পুরো এলাকার মানুষ ওদের নিয়ে গর্বিত।”
আর্জিনা বেগমের প্রতিবেশী মোবারক হোসেন বলেন, “তিন জমজ ভাইয়ের মেডিকেল কলেজ ভর্তির বিষয়টি পুরো গ্রামের জন্য গর্বের। দোয়া করি ওরা চিকিৎসক হয়ে যেন গরিব মানুষের সেবা করে।“
পরিবারটির শুভাকাঙ্ক্ষী চিকিৎসক গোলাম রব্বানী বলেন, “আমি খুব খুশি। গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে। মহান আল্লাহ যেন ওদের ভালোভাবে চিকিৎসক করেন।”
গত বছর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া মাফিউল হাসান মাফি জানান, তারা তিন ভাই বগুড়ায় মেসে থেকে সরকারি শাহ্ সুলতান কলেজের পড়েছেন। মা অনেক কষ্ট ও জমিজমা বিক্রি করে তাদের পড়িয়েছেন।
তিনি বলেন, “তিন ভাই ডাক্তার হবো ভাবতে অনেক ভালো লাগছে।”
এবার দিনাজপুর মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়া শাফিউল হাসান বলেন, “বাবা থাকলে অনেক খুশি হতেন। চিকিৎসক হয়ে যেন মানুষের সেবা করতে পারি, সেজন্য সবার দোয়া চাই।”
নোয়াখালী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া রাফিউল ইসলাম বলেন, “অসুস্থ অবস্থায় বাবা মারা যায়। যখন বিষয়টি জানতে পারলাম তখন থেকেই তিন ভাই ডাক্তারি পড়ার প্রতিজ্ঞা করি। দরিদ্র মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা করব। বাবার মতো যেন কাউকে অকালে ঝরে পড়তে না হয়।”