সম্প্রতি “এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের” ব্যানারে সংগঠিত আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে এনবিআরের কিছু শীর্ষ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো এবং অন্যদের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নজরদারির আওতায় আনার ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
এক জ্যেষ্ঠ এনবিআর কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে বলেন, ‘‘এত অল্প সময়ে এনবিআরে এত কিছু ঘটে যাওয়ার পর পরিস্থিতি কীভাবে সহজ হতে পারে?’’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আন্দোলনে অংশ নেওয়া ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘‘এনবিআরের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধছে এবং এটি গুরুতর রূপ নিতে পারে।’’
প্রশাসনিক অনিয়ম, কর্মকর্তা হয়রানি ও সংস্কার প্রচেষ্টায় বাধার অভিযোগ তুলে এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ ও কাঠামোগত সংস্কারের দাবিতে একাধিক কর্মসূচি পালন করছিল এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ।
গত জুনের শুরু থেকে আন্দোলনরত কর্মকর্তারা দেশজুড়ে কর, ভ্যাট ও কাস্টমস অফিসে সেবা কার্যক্রমে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে সম্পূর্ণ কর্মবিরতি, পদযাত্রা, কর্মবিরতি, অনশন এবং মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন।
গত ১২ মে এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠনের মাধ্যমে সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের যুক্ত করার সুযোগ তৈরি করে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এরপর থেকেই আন্দোলন শুরু হয়।
রবিবার (৩০ জুন) দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের একটি অংশ সরকারের সঙ্গে মধ্যস্ততায় ‘‘কমপ্লিট শাটডাউন’’ ও ‘‘মার্চ টু এনবিআর” কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয় এনবিআর রিফর্ম ইউনিটি কাউন্সিল।
এর আগে এনবিআর সংস্কার ঘিরে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনে পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা পর্যায়ের কমিটি গঠন করে সরকার। এরপর গত বৃহস্পতিবার এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। এনবিআর কর্মকর্তাদের আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তাদের প্রস্তাব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ সময় ‘‘ভয়-ভীতি ও পক্ষপাতহীন’’ হয়ে কাজ করার জন্য এনবিআর কর্মকর্তাদের আহ্বান জানান অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তাছাড়া, এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানকেও অতীত বিরোধ ভুলে দেশের জন্য কাজ করার জন্য বলেন উপদেষ্টা। এতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
কিন্তু একই দিনে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ৬ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগে তদন্ত শুরু করে। এ অভিযোগগুলো গত দুই দশকের কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে।
তদন্তাধীন ছয় কর্মকর্তা হলেন- আয়কর নীতি বিভাগের সদস্য একেএম বদিউল আলম, ঢাকা কর অঞ্চল-৮ এর অতিরিক্ত কর কমিশনার মির্জা আশিক রানা, বিসিএস কর একাডেমির যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দিন খান, ঢাকার কর অঞ্চল-১৬ এর উপ-কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা, অতিরিক্ত কর কমিশনার হাসান তারেক রিকাবদার এবং কাস্টমস-আবগারি ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ) এর অতিরিক্ত কমিশনারসাধন কুমার কুন্ডু।
তাদের মধ্যে হাসান তারেক এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি এবং অন্যরাও বিভিন্নভাবে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।
এরপর মঙ্গলবার (২ জুলাই) আরও ৫ জ্যেষ্ঠ এনবিআর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করে দুদক।
তদন্তাধীন পাঁচ কর্মকর্তা হলেন- বড় করদাতা বিভাগের (ভ্যাট) অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল রশিদ মিয়া, সদস্য মো. লুৎফুর আজিম, কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের (সিআইআইডি) সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক আলমগীর হোসেন, ঢাকার কর অঞ্চল-১৬ এর উপ-কর কমিশনার মো. শিহাবুল ইসলাম এবং যুগ্ম কমিশনার মো. তারেক হাসান।
তবে এখানেই শেষ নয়। বুধবার (৩ জুলাই) প্রশাসন ক্যাডারের শীর্ষ পর্যায়ের তিন এনবিআর সদস্যকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় সরকার। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) ওয়েবসাইট অনুসারে, জনস্বার্থে তাদের সকলকে বাধ্যতামূলক অবসর পাঠানো হয়েছে।
অবসরে পাঠানো ব্যক্তিরা হলেন- শুল্ক নীতি ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের হোসেন আহমেদ ও মো. আলমগীর হোসেন এবং ভ্যাট নীতি বিভাগের মো. আব্দুর রউফ।
এছাড়াও বরিশাল কর অঞ্চলের কমিশনার (সিসি) মো. সব্বীর আহমেদ এবং কর পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিচালক এম মইনুল এরফানকে আগাম অবসরে পাঠানো হয়েছে।
এনবিআর আরও জানায়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার মো. জাকির হোসেনকে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে বাণিজ্য কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটানো এবং রাজস্ব ঘাটতির কারণে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
গত ১ জুলাই (সোমবার) জারি করা এনবিআরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ১৮ জুনের এক নির্দেশনায় সব রাজস্ব সংশ্লিষ্ট অফিস, কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগকে ২১ জুন ও ২৮ জুন খোলা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যাতে রাজস্ব আদায় বাড়ানো যায়।
তবে এ নির্দেশ সত্ত্বেও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ২৮ জুন (শনিবার) ও ২৯ জুন (রবিবার) বন্ধ ছিল, যার ফলে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে এবং সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই কারণ দেখিয়ে এনবিআর তাকে বরখাস্ত করা হয়।
আন্দোলন ও কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার কারণে দেশজুড়ে এনবিআরের অধীন রাজস্ব আদায় কার্যক্রম প্রায় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়। গত ২৮ ও ২৯ জুন এনবিআরের প্রধান প্রধান শাখা, বিশেষ করে কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগ, এনবিআর রিফর্ম ইউনিটি কাউন্সিলের ডাকা ‘‘কমপ্লিট শাটডাউন’’ ও ‘‘মার্চ টু এনবিআর” কর্মসূচির কারণে কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
আন্দোলনরত এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ প্রশাসনিক অনিয়ম, কর্মকর্তা হয়রানি ও সংস্কার প্রচেষ্টায় বাধার অভিযোগে এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণসহ কাঠামোগত সংস্কারের দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি চালিয়ে আসছিল।
এনবিআরের সাবেক এক কমিশনার বলেন, “যাদের জোরপূর্বক অবসরে পাঠানো হয়েছে, তারা সবাই খুবই আন্তরিক ও শতভাগ সৎ ছিলেন। তারা সবাই পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কর্মকর্তা ছিলেন। তারা দক্ষ, সৎ ও যোগ্য ছিলেন বলেই নীতিনির্ধারণী পদে ছিলেন।” তবে কেন এসব কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হলো এবং এর পেছনে এনবিআরের যুক্তি কী, তা তিনি ব্যাখ্যা করতে পারেননি।
তিনি বলেন, “আমি যতটুকু জানি, এই ঘটনায় অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। যেসব কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে তারাই এনবিআরের চলমান অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে দৃঢ় অবস্থানে ছিলেন।”