তিনি জ্বালিয়েছিলেন একটি স্ফুলিঙ্গ। আর তা নক্ষত্রের মতো আলো ছড়িয়েছে পৃথিবীময়। মঙ্গল পথের এই ভিত্তি স্রষ্টা একজন ফজলে হাসান আবেদ। তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক এখন দুনিয়া জুড়ে বাংলাদেশের সমার্থক।
বরেণ্য এই কীর্তিমান ফজলে হাসান আবেদ ধরায় এসেছিলেন ১৯৩৬ সালের আজকের দিন ২৭ এপ্রিল। সিলেটের বানিয়াচং তখনও টের পায়নি দূরদ্রষ্টার আর্বিভাব। তার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে স্পষ্ট হয় তা।
চাইলে ভূস্বামী হতে পারতেন আবেদ। তার পূর্বপুরুষ ছিলেন সে অঞ্চলের জমিদার। পারিবারিক ভাবে দুটি পরগনার মালিক তারা। ফজলে হাসান আবেদের বাবা সিদ্দিক হাসান। মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। দরিদ্র মানুষের প্রতি তার পরিবারের মমতা শৈশবেই প্রভাব ফেলে ফজলে হাসান আবেদের মননে। কারও ঘরে খাবার নেই শুনলে সঙ্গে সঙ্গে চাল পাঠিয়ে দিতেন তার মা। কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। অনেক ভাবে অসহায় দরিদ্র মানুষ পাশে দাঁড়ানোর এই শিক্ষা ছোটবেলায় পান ফজলে হাসান আবেদ।
ফজলে হাসান আবেদ তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর তিনি ভর্তি হন কুমিল্লা জেলা স্কুলে। সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানেই পড়েন। নবম শ্রেণীতে তিনি ভর্তি হন পাবনা জেলা স্কুলে। সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৫২ সালে। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। সেখান থেকে ১৯৫৪ সালে আইএসসি পাস করেন। সে বছরই ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিভাগ ছিল পদার্থ বিজ্ঞান।
ফজলে হাসান আবেদের চাচা সায়ীদুল হাসান তখন লন্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসের বাণিজ্য সচিব। তিনি বললেন, স্কটল্যান্ড চলে যাও। গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হও। ১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে স্কটল্যান্ডের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান ফজলে হাসান আবেদ। চোখে স্বপ্ন দেশের প্রথম নেভাল আর্কিটেক্ট হবেন। গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে বছর দেড়েক পড়াশুনা করলেন তিনি। কিন্তু সেখানের শিপ ইয়ার্ডগুলো ঘুরে দেখে মনে হলো দেশে গিয়ে লেখাপড়াটা কাজে আসবে না। যখন নেভাল আর্কিটেকচার পড়তে গিয়েছিলেন তখন একটা রোমান্টিসিজম ছিল। স্বপ্নের হাতছানি ছিল। দেশের প্রথম নেভাল আর্কিটেক্ট হবেন এমন একটা ভাবনা তাকে আলোড়িত করত। কিন্তু যখন তিনি বুঝতে পারলেন এই পড়াশোনাটা দেশের মানুষের কাজে আসবে না তখন তার এ বিষয়ে আগ্রহ থাকলো না। দুবছর এ বিষয়ে পড়ে তা অসমাপ্ত রেখে লন্ডনে চলে আসেন। এবার ভর্তি হন অ্যাকাউন্টিংয়ে। ভাবলেন চাটার্ড অ্যাকাউটেন্ট হয়ে দেশে ফিরে যাবেন।
কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ের উপর চার বছরের প্রফেশনাল কোর্স করেন তিনি। পড়া শেষ হয় ১৯৬২ সালে। পাস করার পর লন্ডনে চাকরিতে যোগ দিলেন। ইংল্যান্ড থেকে এরপর চলে আসেন কানাডায়। এরপর চাকরি সূত্রে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে। কর্মক্ষেত্র নিউ ইয়র্ক। এভাবে এক দেশে থেকে আরেক দেশে। এক পর্যায়ে আর বিদেশ ভালো লাগে না। দেশের পথে পা বাড়ালেন ফজলে হাসান আবেদ।
১৯৬৮ সালে দেশে ফিরে আসেন ফজলে হাসান আবেদ। আইয়ুবের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দেশ তখন উত্তাল। ফজলে হাসান আবেদ যোগ দিলেন বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেলের হেড অব ফিন্যান্স পদে। সত্তরের নির্বাচনের আগে ১১ নভেম্বরে রাতে দেশে খুব শক্তিশালী একটি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস আঘাত হানে। চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর উপকূলীয় দ্বীপগুলো সে রাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। সন্দীপ, হাতিয়া ও মনপুরা এই ৩ দ্বীপে নিহত হন অসংখ্য মানুষ। দ্বীপগুলো ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়। মৃত্যু হয় প্রায় তিন লাখ মানুষের। মনপুরা দ্বীপে বাস করতেন ছাপান্ন হাজার মানুষ। এদের মধ্যে বেঁচে ছিলেন মাত্র ১৩ হাজার।
এই ঘূর্ণিঝড় আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ অনুভব করেন ফজলে হাসান আবেদ। ক’জন বন্ধু মিলে তখন গড়ে তুললেন “হোপ” নামে একটি সংস্থা। শুরু হয় সব হারা মানুষের মাঝে হেলপের কার্যক্রম মনপুরায়। জার্মানির একটি সংস্থা থেকে তিন মিলিয়ন ডয়েচ মার্ক অনুদান মেলে। শুরু হলো মনপুরা দ্বীপকে ফের গড়ে তোলার কাজ।
১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মানুষ ছুটছে ভারত অভিমুখে। ফজলে হাসান আবেদ স্বীদ্ধান্ত নিলেন তিনি লন্ডনে যাবেন। কারণ সেখানে আগে থেকেই তার জানা শোনা ছিল। তার ইচ্ছে ইংল্যান্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য একটি সংগঠন দাড় করাবেন। গঠন করলেন “অ্যাকশন বাংলাদেশ” নামে একটি সংস্থা। তখন জুন মাস। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তখন লন্ডনে পৌঁছেছেন। প্রথমে শুরু করলেন জনমত গঠনের কাজ। এজন্য প্রথমেই তারা লন্ডন টাইমস পত্রিকায় বড় একটি বিজ্ঞাপন প্রচার করেন। বিজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশে গণহত্যা চলছে। এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ও জাতিসংঘের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। চলতে থাকে প্রচারণা ও তহবিল সংগ্রহের কাজ। তাদের পাঠানো অর্থ ব্যয় হতো ভারতের শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায়। এরপর শহীদের এক সমুদ্র রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি দেশে ফেরেন ফজলে হাসান আবেদ।
ভারত থেকে শরণার্থীরা তখন ফিরে এসেছেন। প্রতিটি গ্রাম তখন ধ্বংস স্তুপ। ঘরে ঘরে খাদ্যের জন্য হাহাকার। সুপেয় পানি নেই। নেই চিকিৎসা সেবার ন্যূনতম ব্যবস্থা। এ অবস্থায় বসে থাকার সুযোগ নেই। সিলেটের শাল্লা এলাকায় কাজের স্বীদ্ধান্ত নিলেন ফজলে হাসান আবেদ। তার যুক্তি ছিল, শহরে অনেকে কাজ করবেন কিন্তু গ্রাম উপেক্ষিত থাকবে। তার মনে হলো, এ অঞ্চলের মানুষের জন্য কিছু করা খুব জরুরি।
এত দিন বিদেশে বসে দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন। এবার স্বাধীন দেশের দরিদ্র অসহায় ও সব হারানো মানুষের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করতে হবে। এজন্য দরকার প্রতিষ্ঠান। এর নাম দিলেন বাংলাদেশ রিহ্যাবিলেটশন অ্যাসিসট্যান্স কমিটি। সংক্ষেপে ব্র্যাক। এটি ছিল ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা। কিন্তু কাজের জন্য চাই তহবিল। টাকা ছাড়া তো কাজ আগাবে না। লন্ডনে ফজলে হাসান আবেদের একটি ছোট ফ্ল্যাট ছিল। এটি বিক্রি করে দেন তিনি। এখান থেকে পাওয়া গেল ৬,৮০০ পাউন্ড। নিজের গাড়ি, নিজের বাড়ি এসব বৈসয়ীক বিষয় নিয়ে তখন মাথায় কোনো ভাবনা ছিল না। বহুজাতিক কোম্পানিতে লোভনীয় চাকরি আর ফজলে হাসান আবেদকে টানলো না। ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্বাধীন দেশের বিনির্মাণে।
সুনামগঞ্জের শাল্লা দিরাই ভাটি অঞ্চল ছিল ব্র্যাকের প্রথম কর্মক্ষেত্র। এখানেই শুরু হয় পরবর্তি সময়ে মহীরুহ হয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা। শাল্লা প্রকল্পের প্রথম পর্বে আওতাভুক্ত এলাকাগুলো ছিল সমগ্র শাল্লা থানা, দিরাই থানার তিনটি ইউনিয়ন, আজমেরিগঞ্জ এবং বানিয়াচং থানার সাতটি গ্রাম। সব মিলিয়ে ১৮৭ টি গ্রামের ৮৮ হাজার মানুষকে নিয়ে কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়।
শাল্লা প্রকল্পের প্রথম পর্বে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ১০,৪০০ গৃহ নির্মাণ করা হয়। ফজলে হাসান আবেদ উপলব্ধি করেন শুধু ত্রাণ দিয়ে দরিদ্র মানুষের সমস্যার দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান সম্ভব নয়। দরিদ্র মানুষের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন তাদের সাবলম্বী করে তোলা, আত্ম নির্ভরতার সন্ধান দেয়া। তার জন্য দীর্ঘ স্থায়ী উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে অগ্রসর হতে হবে।
শাল্লা প্রকল্পের প্রথম পর্বে ব্র্যাক তার কার্যক্রমের যে বুনিয়াদ গড়ে তোলে দ্বিতীয় পর্বে এসে আরও পরিকল্পিত উপায়ে বৃহত্তর ক্ষেত্রে সেই কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটায়। এ পর্বে মোট ১৬৮ বর্গমাইল এলাকার ২০০ টি গ্রামের প্রায় দেড় লক্ষ মানুষকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের আওতায় আনা হয়। এর নেতৃত্বে থাকা ফজলে হাসান আবেদ লক্ষ্য রাখেন কর্মসূচির আওতাভুক্ত মানুষগুলো যেন সাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে। এক সময় তারা যেন নিজেরাই নিজেদের কাজ পরিচালনা করতে পারে। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ১৭৫ টি গণকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষ হয়। এই কেন্দ্রগুলো ব্র্যাকের বহুবিধ কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হত।
ব্যাংকিং শাস্ত্রের নিয়ম ভেঙে করে দরিদ্র মানুষের জন্য ঋণের যোগান দেয় ব্র্যাক। সফলও হয় এ কার্যক্রম। এ বিষয়ে ফজলে হাসান আবেদের ভাষ্য, ১৯৭৬ সালের প্রথম দিকে আমরা ব্যক্তিকে একক ঋণ দিতে শুরু করলাম। একজন ব্যক্তি যখন ঋণ নিচ্ছেন, তখন ঋণের পুরো দায় দায়িত্ব তার নিজের। লোকসান হলে তার নিজের। লাভ হলেও তাই। দেখা গেল এখন আর তিনি কাজে ফাঁকি দিচ্ছেন না। ব্যবসা ঠিকমতো চলছে। কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করছেন। এভাবে ঋণের টাকা ঠিক মতো ফেরত আসতে শুরু করলো।
ফজলে হাসান আবেদ তার কর্মকাণ্ডের শুরুতেই দুর্গত মানুষকে একত্র করে তাদের সম্মিলিত শক্তির জাগরণ ঘটাতে চান। সেজন্য প্রকল্প এলাকায় সমবায় সমিতি গড়ে তোলার উপর বিশেষ জোর দেন তিনি। শাল্লা প্রকল্পের প্রথম পর্বে ব্র্যাক কর্মীরা ২ টি নতুন সমবায় সমিতি গড়ে তোলেন। দ্বিতীয় পর্বে এসে ব্র্যাক তার সমবায় প্রচেষ্টা আরও শক্তিশালী করে তোলে। কর্ম এলাকায় গড়ে তোলা হয় ২২০ টি সমিতি।
এরপর একে একে স্বাস্থ্য সেবা, খাদ্য উৎপাদন, অবকাঠামো উন্নয়নসহ মানুষের প্রতিটি মৌলিক চাহিদা পূরণে কাজ শুরু করে ফজলে হাসান আবেদের নেতৃত্বাধীন ব্র্যাক। ১৯৭৪-৭৫ সালে শুকনো মৌসুমে প্রথমবারের মতো ব্র্যাক কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি হাতে নেয়। আস্তে আস্তে পুরো দেশই পরিণত হয় তাদের কর্মক্ষেত্রে।
এক সাক্ষাৎকারে ফজলে হাসান আবেদ বলেছিলেন, “কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, বাংলাদেশের আশানুরুপ উন্নয়নে ব্র্যাকের অবদানের সফলতার পেছনের রহস্য কী? তাহলে প্রথমেই আমি বলব সফলতার জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ ছিল আমাদের প্রধান অস্ত্র। আমরা দরিদ্র মানুষদের জীবন পরিবর্তনে স্থির ছিলাম। এর পরবর্তি পর্যায়ে আমরা সব কিছুই জাতীয়ভাবে চিন্তা ভাবনা করতাম। আমাদের সকল পরিকল্পনা ছিল জাতীয় পর্যায়ের। ছোট্ট একটা এলাকা নিয়ে কাজ করায় আমরা বিশ্বাসী ছিলাম না। আমরা ভাবতাম ঠিক আছে আমরা এখন যদি দেশের এই ছোট্ট একটা দরিদ্র অংশের সাথে কাজ করি তাহলে দেশের অন্য প্রান্তে আরো দরিদ্র মানুষদের জন্য কারা কাজ করবে? তাই আমরা ভাবলাম আমরা যাই করব আমরা চেষ্টা করব জাতীয় পর্যায়ে সেটা ছড়িয়ে দিতে। তৃতীয় যে বিষয়টা আমাদের সফলতার পেছনে আছে সেটা হলো উদ্যোম আর উৎসাহ। আমরা কখনো থেমে যাই নি। পিছপা হইনি। আমরা সব সময় জাতীয় পর্যায়ে চিন্তা করেছি, স্থানীয় মানুষদের নিয়ে কাজ করেছি এবং বিশ্ববাসির কাছে সেই কাজটাকে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে তৈরি করার চেষ্টা করেছি। আমরা পাওলো ফ্রেইরির কাজ থেকেও উৎসাহ পেয়েছি। তিনি আমাদেরকে এই উপলব্ধি করতে সহায়তা করেছেন যে, দরিদ্ররাও মানুষ এবং তারা নিজেদের উন্নয়নে কাজ করতে পারেন। আমাদের কাজ হলো তাদেরকে আরো শক্তিশালি করা, নিজেদের অবস্থা যেন তারা বুঝতে পারেন সেই বিষয়ে সহায়তা করা এবং তাদের ভাগ্য উন্নয়নে সাহায্য করা।
আরও একটা বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হয়েছিল। আমরা জানতাম শুধু মাত্র উচ্চাবিলাসী হলে চলবে না আমাদেরকে। কাজের যোগ্যতাও অর্জন করতে হবে। একটা প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় পর্যায়ের কাজ করতে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আমাদের এই আত্মবিশ্বাস অর্জিত হয়েছিল ৮০ দশক থেকে যখন আমরা দশ বছরে প্রায় এক কোটি ত্রিশ লক্ষ মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদেরকে ডায়রিয়ার প্রকোপ বিষয়ে স্বাস্থ্য সচেতন করতে পেরেছিলাম। এর পরই আমরা আরো বেশি সাহসি হয়ে উঠি। আমরা বুঝতে পারি পুরো দেশেই আমরা এই রকম আরও অসংখ্য কাজ ইচ্ছে করলেই করতে পারব।
আমরা ওরাল রিহাইড্রেশন প্রোগ্রাম শুরু করলাম তখন আরো ১৭০০ জন কর্মী যোগ হলো আমাদের সাথে। তারপর ক্রমশ আমাদের কর্মী বাহিনী বাড়তে থাকল। ১৯৯০ এর দিকে সেটা দাড়াল ২০০০ জনে। তবে ১৯৯০ থেকে ২০০০ এর মধ্যে খুব দ্রুত আমাদের কর্মী বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। ২০০০ এর শেষের দিকে সেটা দাড়াল ২৫০০০ জন।
ওরাল রিহাইড্রেশন প্রোগ্রাম আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল। নাটকীয়ভাবে আমাদের এই কার্যক্রমের জন্য শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার কমে গেল। হাজারে ২৫৮ শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার থেকে নেমে সেটা এসে দাঁড়ালো হাজারে ৭৫ এ। ১৯৯০ এর দিকে যখন আমরা এই প্রকল্পে আশানুরুপ সফলতা পেলাম ব্র্যাক তখন আরও বিস্তৃত আকারে দাতা খুঁজতে শুরু করল। ওরাল রিহাইড্রেশন প্রোগ্রামে আমার তহবিল ছিল ১৫ মিলিয়ন ডলার। নব্বইয়ের পরে সেটার প্রয়োজন দাড়াল ৯০ মিলিয়ন ডলারে। কিন্তু আমাদের এই ধরনের প্রকল্পে সেরকম কোনো দাতা আমরা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এই অবস্থায় আমাদের দাতা পরিবর্তন হলো। আমরা এনজিওর দিকে হাত বাড়ালাম যারা আমাদের ফান্ড সংগ্রহ করতে সহায়তা করেছে। অক্সফাম, ফোর্ড ফাউন্ডেশন এরা আমাদেরকে সহায়তা করতে শুরু করল। এর পর ব্রিটিশ গর্ভনমেন্ট, জার্মান, সুইডিশ সিডা, কানাডিয়ান সিডা, নরওয়েজিয়ান সহ নানা দেশের সরকার আমাদেরকে ফান্ড সংগ্রহে সহায়তা করল। আমরা খুব দ্রুত এগুতে থাকলাম। বাংলাদেশ সরকার যদিও অন্যান্য দাতা সরকারদের মতো ছিল না। তারা আমাদেরকে সহায়তা করেনি তবে তারা আমাদেরকে নানা দেশ থেকে ফান্ড সংগ্রহ করার সময় বাঁধাও দেয়নি। ভারত কিংবা কেনিয়ার সরকারের মত বাংলাদেশের সরকার আমাদেরকে কোনো বাঁধা দেয়নি। ব্র্যাকের মতো এত বড় আর শক্তিশালি একটা এনজিও ভারত কিংবা কেনিয়ার মতো দেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব না। বাংলাদেশ সরকার যদিও আমাদেরকে কোনো রকম সহায়তা কিংবা সেবা দেয়নি তারপরেও তারা আমাদের উন্নয়নে কোনো বাধা দেয়নি।
বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে। আন্তর্জাতিক কমিউনিটি আমাদেরকে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে কিন্তু প্রয়োজনে আমাদের ভাঙা ঘর আমাদের নিজ হাতেই ঠিক করতে হবে। উদাহরণ সরূপ জলবায়ু পরিবর্তনে সহায়তার যে অঙ্গীকার আন্তর্জাতিক কমিউনিটি দিচ্ছে এবং যে ফান্ড এখন খুব সহজেই পাওয়া সম্ভব সে বিষয়ে বাংলাদেশকে আরো তৎপরতার সাথে এগুতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনে যে ফান্ড এখন পাওয়া সম্ভব সেটা সুষ্ঠভাবে ব্যবহার করতে আমরা কি প্রস্তুত? আমি এর উত্তরে বলব, না। এই সমস্ত ফান্ড সুষ্ঠভাবে ব্যবহার করার জন্য আমাদেরকে আরো নিয়ন্ত্রিত এবং স্বচ্ছ পরিকল্পনা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে সামাজিক ভাবে আমাদের দায়িত্ববোধ আরো বাড়াতে হবে। এই মুহূর্তে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি নিয়ে ব্র্যাকের দুটো কেন্দ্র সমান্তরাল ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এই কেন্দ্রগুলো বৈশ্বিক বিপর্যয় ব্যবস্থা নিয়ে রীতিমত পড়াশোনা আর গবেষণা করছে। আমরা মনেকরি, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিপর্যয় রোধে আমাদের নিজস্ব দক্ষতা ও ক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে আমাদের কাজটা আমাদেরকেই করতে হবে।”
দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ফজলে হাসান আবেদের উন্নয়ন ভাবনা প্রশংসিত হয়েছে পুরো পৃথিবী জুড়ে। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত আফগানিস্তানসহ বহু দেশে এখন কাজ করছে ব্র্যাক।
ফজলে হাসান আবেদ সামাজিক ক্ষেত্রে তার অনন্য সাধারণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বিশ্ব জনস্বাস্থ্যে বিশেষ অবদান এবং বিশ্বব্যাপী দরিদ্র লোকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য তিনি ২০১৬ সালে “টমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র মেডেল অব গ্লোবাল পাবলিক হেলথ” পদক লাভ করেন। খাদ্য ও কৃষি ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৫ সালে “ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ” লাভ করেন। ২০১৩ সালে তিনি হাঙ্গেরির “সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি” (সিইইউ) কর্তৃক প্রদত্ত “ওপেন সোসাইটি প্রাইজ” লাভ করেন। ২০১১ সালে তিনি কাতার ফাউন্ডেশন প্রবর্তিত শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার “ওয়াইজ প্রাইজ” লাভ করেন। ২০১০ সালে দারিদ্রবিমোচনে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ফজলে হাসান আবেদ যুক্তরাজ্যের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মানজনক উপাধি “নাইটহুড” লাভ করেন। এছাড়া তিনি ডেভিড রকফেলার ব্রিজিং লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড(২০০৮), ক্লিনটন গ্লোবাল সিটিজেনশিপ অ্যাওয়ার্ড(২০০৭), হেনরি আর. ক্রাভিস প্রাইজ ইন লিডারশিপ(২০০৭) দারিদ্র দূরীকরণ ও সামাজিক উন্নয়নে অবদানের জন্য পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন(পিকেএসএফ) প্রদত্ত আজীবন সম্মাননা(২০০৭), গেটস অ্যাওয়ার্ড ফর গ্লোবাল হেলথ (২০০৪), মানব উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য ইউএনডিপি অ্যাওয়ার্ড(২০০৪), দ্যা শোয়াব ফাউন্ডেশন সোশ্যাল অনট্রাপ্রেনিওর অ্যাওয়ার্ড (২০০২) ওলফ পামে অ্যাওয়ার্ড (২০০১), ইউনিসেফ মরিস পেট অ্যাওয়ার্ড (১৯৯২), ইউনেস্কো নোমা পুরস্কার (১৯৮৫) এবং র্যামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড ফর কমিউনিটি লিডারশিপ (১৯৮০) লাভ করেন। মানবিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ব্র্যাক বিশ্বের আলোচিত পুরস্কার কনরাড এন. হিলটন হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাওয়ার্ড (২০০৮) এবং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ (২০০৭) অর্জন করে। এছাড়া বিশ্বের খ্যাতনামা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি অর্জন করেছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর শুক্রবার ৮৩ বছর বয়সে এই কর্মে ক্লান্ত যোদ্ধা চির ঘুমের দেশে পাড়ি জমান। কিন্তু তার কীর্তি আজও ভাস্বর। অনেক কারণেই ইতিহাস তাকে মনে করবে। প্রতিষ্ঠান বিরোধীদের কথা বাদ। কোনো হঠাৎ ভাবাবেগে আমরা “ভেঙে ফ্যালো, ভাঙতে হবে” ইত্যাদি কথা বলে ফেলি। যদিও আমাদের সক্ষমতা নেই একটি কার্যকর ভিত্তির প্রতিষ্ঠান নির্মাণের। কারও থাকা, না থাকায় যে প্রতিষ্ঠানের গতিধারা বিঘ্নিত হবে না। স্যার ফজলে হাসান আবেদের জীবন থেকে এ শিক্ষা মেলে। তার মিতবাক স্বভাব ও প্রভাবশালী হওয়া স্বত্বেও কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতার মুখাপেক্ষি না হওয়াও তার অনন্য গুণ। তার কাছে ফিরতে হয় তাই বারবার। জন্মবার্ষিকীতে অনন্ত শ্রদ্ধা ফজলে হাসান আবেদের প্রতি!