একাত্তরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর। অবরুদ্ধ ঢাকায় সুপ্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর রীতিমতো নরক নেমে আসে। স্বপ্নেও তাদের ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন গেরিলাযুদ্ধে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত একঝাঁক তরুণ। আচমকা “হিট অ্যান্ড রান” পদ্ধতিতে বিভিন্ন স্থাপনা, চেকপোস্ট কিংবা পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে আক্রমণ চালিয়ে পলকেই উধাও হয়ে যেতেন অসমসাহসী সেই গেরিলারা।
এই দুঃসাহসী শহুরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অভিযানের নাম ছিল “উলান পাওয়ার স্টেশন অপারেশন”।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের সবচেয়ে সুরক্ষিত দুর্গ ছিল ঢাকা শহর। এই শহরে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান প্রবলভাবে জানান দিতে জুনের শুরুতে ১৭ জনের একটি গেরিলা দল শহরে ঢোকে। প্রথম দফায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে গ্রেনেড বিস্ফোরণ করা হয়। এরপর ওয়াপদা গেট, পুরানা পল্টন, বিভিন্ন সিনেমা হল ইত্যাদি নানা স্থাপনায় চলে বোমা হামলা।
পাকিস্তানিদের প্রাণে কম্পন ধরিয়ে চলে যায় গেরিলারা। দ্বিতীয় দফায় জুলাই মাসে আরও উন্নত অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ নিয়ে ঢাকায় ঢুকে একের পর এক সফল অপারেশন করতে থাকে দলটি।
প্রথম দিকে পাওয়ার লাইন ও কেবল লাইন উড়িয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছিলেন গেরিলারা। কিন্তু দেখা গেল এই বাধা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না, দেড় থেকে দুই দিনের মধ্যেই পাকিস্তানিরা লাইন ঠিক করে ফেলছে। সুতরাং আরও দীর্ঘস্থায়ী বিঘ্ন ঘটানোর চিন্তা থেকেই পাওয়ার স্টেশনগুলোতে হামলার পরিকল্পনা করা হয়।
ঢাকা শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান পাঁচটি কেন্দ্র ছিল ঢাকার মোট পাঁচটি পাওয়ার স্টেশন। গেরিলাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল এই স্টেশনগুলো উড়িয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস করা। পাওয়ার স্টেশনগুলো ছিল- উলান পাওয়ার স্টেশন (একটি ট্রান্সফর্মার, ১৩২/১৩৩ কেভি;৩০/৪০/৫০ এমভিএ); খিলগাঁও/গুলবাগ পাওয়ার সাবস্টেশন (৩৩/৩১ কেভি; দুটি ট্রান্সফর্মার ৫ এমভিএ করে); কমলাপুর পাওয়ার সাবস্টেশন; ধানমন্ডি পাওয়ার হাউস এবং তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল পাওয়ার হাউস।
তৎকালীন ওয়াপদার বিজলী সরবরাহ বিভাগের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলাম এবং তার এক সহকর্মী এই বিদ্যুৎ সরবরাহকেন্দ্রগুলো আক্রমণে গেরিলাদের সর্বাত্মক সহায়তা করলেন। (নজরুল ইসলাম পরবর্তীতে শহিদ হয়েছিলেন)।
আরও পড়ুন- ক্র্যাক প্লাটুনের ‘অপারেশন ইন্টারকন্টিনেন্টাল'
তারা জানালেন, সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী ছটি সংযোগ ঢাকার ছয় স্টেশনে এনে অন্যান্য সাবস্টেশনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। সেই ছয়টি পাওয়ার স্টেশন ও তার ট্রান্সফর্মারগুলো উড়িয়ে দিতে পারলে পুরো ঢাকা নগরী অন্ধকারে ডুবে যাবে। টেলিভিশন ও রেডিও স্টেশনগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। পাকিস্তানি সামরিক সরকারের ঢাকা শহর গতিশীল রাখার লক্ষ্য চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।
এই দু'জন প্রকৌশলী গেরিলাদের প্রতিটি পাওয়ার স্টেশনের ডিটেইলস ম্যাপিং করে দেখালেন এবং বিভিন্ন ট্রান্সফর্মারের ডিজাইন ও ছবি সরবরাহ করলেন। পাশাপাশি তারা কীভাবে ট্রান্সফর্মারগুলো উড়িয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি অকেজো করে দেওয়া যাবে তাও ডায়াগ্রাম এঁকে দেখিয়ে দিলেন। ছয়টি পাওয়ার স্টেশনে একত্রে হামলা করার মতো লোকবল গেরিলাদের ছিল না। সে কারণে বেশ কয়েকবার বৈঠক করে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা পাঁচটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে একটি করে স্টেশনে অপারেশন চালাবেন।
কিন্তু পাওয়ার স্টেশন নির্বাচনের পরিকল্পনায় তাদের কিছুটা ভুল হয়ে যায়। উলান, খিলগাঁও/গুলবাগ, কমলাপুর সাবস্টেশন ছাড়া তাদের আক্রমণের জন্য নির্ধারিত বাকি দুটো স্টেশনের কোনোটিই সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে আসা মূল সংযোগের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত ট্রান্সফর্মার বিশিষ্ট সাবস্টেশন ছিল না। ফলে এই দুটো সাবস্টেশনে হামলা চালিয়ে অকার্যকর করে লাভ হবে না। সুতরাং তারা প্রথম তিনটি স্টেশনেই হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেল।
ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ব্যবসায়ী আবদুস সামাদের নিউ ইস্কাটন রোডের বাসা এবং মাসুক সাদেক চুল্লুর ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডের বাসায় সিদ্ধান্ত হলো, অপারেশন হবে ১৯ জুলাই।
পাকিস্তানি সামরিক সরকার ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরু করেছিল তখন। জান্তা সরকার তাদের গণহত্যা ও নির্বিচার ধ্বংসলীলা চাপা দিতে দুনিয়ার সামনে দেখাতে চেয়েছিল, ঢাকা শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। কোনো যুদ্ধ বা সংকট নেই। তারই অংশ হিসেবে তারা শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষার আয়োজন করেছিল এবং সব স্কুল খোলা রেখে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কড়া নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এই পরীক্ষা বর্জনের আহ্বান জানায়। তাতে সাড়া দিয়ে পরীক্ষা বাধাগ্রস্ত করে আসল পরিস্থিতি তুলে ধরতে পাওয়ার স্টেশনগুলোতে গেরিলা আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়।
গাজী দস্তগীর, মতিন (১), মতিন (২), জিন্নাহ, নীলু ও হাফিজ- এই পাঁচজন অপারেশন চালিয়েছিলেন উলান পাওয়ার স্টেশনে। এদের মধ্যে হাফিজ পরবর্তীতে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েন এবং শহিদ হন। অন্যদিকে গুলবাগ পাওয়ার স্টেশন ওড়ানোর নায়ক ছিলেন পুলু, সাইদ, জুয়েল, হানিফ, মুখতার, মোমিন, মালেক ও বাশার। এদের মধ্যে জুয়েল ও বাশার পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েন, জুয়েল শহিদ হন। দুটো অপারেশনেই দুর্দান্ত সাফল্যে শেষ হয়, অকেজো হয়ে পড়ে উলান পাওয়ার স্টেশনের ৩০/৪০/৫০ এমভিএ ট্রান্সফর্মার, ক্ষতি হয় প্রায় ১৫ লাখ টাকা এবং ওয়াপদার ৩৩/৩১ কেভি গুলবাগ পাওয়ার সাব-স্টেশনের ৫ এমভিএ বিশিষ্ট ট্রান্সফর্মার। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি ও শহরের সার্বিক ভোগান্তি ছাড়াও এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সুদূরপ্রসারী।
রা'আদ রহমান, গবেষক ও কলাম লেখক