“পৃথিবী আমার আমি হেঁটে যাব/কেন কাঁটাতার কাঁটাতার খেলা” এই দ্রোহের উচ্চারণ কেবল মানুষকেই করতে হয়। মানচিত্র মানে না পাখিরা; প্রকৃতিও অধীন নয় কোনো সীমারেখার। বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা ভারত-নেপালের সীমান্ত বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে দেখা দিচ্ছে পঞ্চগড়ে। দেশের সর্ব উত্তরের জেলায় প্রতি বছরের মতো এবারও খালি চোখে দেখা যাচ্ছে সিকিম সীমান্তে অবস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘার নৈসর্গিক রূপ। গত কয়েক দিন ধরে ভোর থেকে সন্ধ্যার মধ্যে বিভিন্ন সময়ে দৃশ্যমান হচ্ছে এটি।
মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) সকালে সূর্য ওঠার পর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দিয়েছে। সূর্যকিরণের তেজ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এটি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এর আগে গত বৃহস্পতি ও শনিবারও বেশ স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয় পর্বতশৃঙ্গটি। এছাড়া মাসের শুরুর দিকেও পর্বতশৃঙ্গটির দেখা মিলেছে কিছু সময়ের জন্য।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে প্রতি বছর শীতের আগে আগে মেঘমুক্ত নীলাকাশের নিচে দেখা যায় তুষারাচ্ছাদিত শ্বেতশুভ্র হিমালয় পর্বত ও কাঞ্চনজঙ্ঘা। মেঘ আর কুয়াশামুক্ত উত্তর-পশ্চিম আকাশে তাকালে মনে হবে চোখের সামনেই সাদা পাহাড়। বিশেষ করে ভোরের আকাশে বরফ আচ্ছাদিত নয়নাভিরাম পর্বতটি দেখা বেশ উপভোগ্য।
মোহনীয় রূপে আচ্ছাদিত এই কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। ভোরে সূর্যোদয়ের সময় মনে হয় কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন সাদা বরফে আচ্ছাদিত। দিনের প্রথম সূর্যকিরণ বরফে এমনভাবে প্রতিফলিত হয় মনে হয় সোনালি পাহাড়। বেলা বাড়লে বদলে যায় সেই রূপ। দিনের মধ্যভাগে মনে হয় প্রকাণ্ড মেঘ উত্তরের আকাশটা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। বিকেলের কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন লজ্জারাঙা।
তেঁতুলিয়া থেকে হিমালয়ের এই পর্বতশৃঙ্গের দূরত্ব মাত্র ১০০ কিলোমিটার। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে মূলত পর্যটকরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং শহরের টাইগার হিলে ভিড় করেন। পর্বতটির চূড়া দেখার সবচেয়ে জুতসই জায়গা এটাই। কেউ কেউ সান্দাকপু বা ফালুট যান। অনেকে সরাসরি নেপালে গিয়ে এটি উপভোগ করেন। তবে দেশের ভূখণ্ড থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা অবলোকনের জন্য সেরা জায়গা তেঁতুলিয়ার মহানন্দা নদীর পাড়ের ডাকবাংলো ও পিকনিক কর্নার। কাঞ্চনজঙ্ঘা ঘিরে গত কয়েক বছর ধরে ব্যাপক পর্যটক সমাগম হয়েছে উত্তরের এই জেলাটিতে।
তবে দেশের রাজনৈতিক বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে এ বছর কিছুটা পর্যটক খরা চলছে। তবে প্রশাসন বলছে, পর্যটকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতে তারা কাজ করছেন। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও ট্যুরিস্ট পুলিশ সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে টাঙ্গাইল থেকে পঞ্চগড়ে এসেছেন ইলিয়াস হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘খালি চোখে এই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে অনেকটা পথ ভ্রমণ করে এসেছি। হরতাল অবরোধের কারণে রাস্তায় বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে। তবে আসা সার্থক হয়েছে।”
বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে এসেছেন ফারহান ইসতিয়াক। তিনি বলেন, “আমরা ভোরে কাঞ্চনজঙ্ঘা উপভোগ করেছি। খুব ভালো লেগেছে। অনেক আনন্দ পেয়েছি। সময় পেলে আবারও আসব। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও উত্তরের এই জেলাটিতে অনেক কিছুই দেখার মতো রয়েছে। যা আমাদের মুগ্ধ করছে।”
ঠাকুরগাঁও থেকে এসেছেন আলোকচিত্রী মিলন হোসেন। তিনি বলেন, “শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করার মোক্ষম সময় ভোর ও বিকেল বেলা। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নানান রঙ নিয়ে হাজির হয় বরফে আচ্ছাদিত এই পর্বতচূড়া। কখনো শুভ্র, কখনো গোলাপি, আবার কখনো রক্তবর্ণ ধারণ করে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্তবশৃঙ্গটি।”
ট্যুরিস্ট পুলিশ পঞ্চগড় জোনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাজেদুর রহমান ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছি। প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো পিকনিক কর্নারে ট্যুরিস্ট পুলিশ মোতায়েন থাকে।”
পর্যটকদের জন্য হেল্প ডেস্ক তৈরি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।