মানুষ ছুটছেই। ঘুম চোখে ভোরে। চৈত্রের দুপুরের রোদে। সন্ধ্যায় ইফতারের আগে। খুব বেশি রকম এ সময়টায়।
কিন্তু কত দূর আর ছুটতে পারা যায়? দায়হীন উন্নয়নে শহরটি জ্যামে স্থবির। আটকে থাকতে হয় পথে থেকে পথে। তখন দর্শক কারও হয়তো একটু অবসর মেলে। মুহূর্ত দেখার। মুহূর্ত বোঝার।
বাইকের শিশু সামনে। তার পেছনে চালক বাবা। তার পেছনে মায়ের হাতে কেনা ইফতার। ইফতার মানে বছরের পর বছর মিডিয়ার চকবাজার লাইভ। বড় বাপের পোলায় খায়- এর বিবিধ বৃত্তান্ত। কোনো চ্যানেলে রান্নার অনুষ্ঠান। রিমোট ঘুরালে আবার ইসলামী অনুষ্ঠান। সবই স্পন্সরড। পিক আওয়ারে চড়া রেটে টিভি মালিকের পয়সা উসুল।
রাস্তায় সাইরেন বাজানোর মতো ব্যাধি কম নেই ক্ষমতাবান অনেকের। জ্যামে অত্যাচার সপ্তমে পৌঁছে এদের কারণে। গর্ভের শিশুর জন্যও ক্ষতিকর ঢাকার এই শব্দ দূষণ। এ তথ্য গুলে বেটে খাওয়ালেও বিরামহীন থাকবে হর্ন, সাইরেনওয়ালারা।
ইফতারে বাইরে থাকা মানুষের শুধু ঘর মনে পড়ে। যে ঘরে মা বানায় বেগুনি। বোন ভাজে পিঁয়াজু। ভাই চেপে দেয় শরবতে লেবু। আর আব্বা ধুয়ে এনে প্লেটে প্লেটে দেয় খেজুর।
মসজিদের শহরের মাইকে স্পষ্ট হয় ‘‘হাইয়া আলা সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ . . .’’ তার আগেই চুমুক। তার আগেই খেজুর।
রোজার শহরে ইফতার তাই যেন এক ফুলস্টপ। ছেদ পড়ে গতিতে। আবার মুখরতার অপেক্ষায়।
শপিংমলগুলো মাইকে ডেকেই যায়। বিশেষ ছাড়ের ধামাকা অফার। রোজার শুরু আর শহরবাসীর ঢাকা ছাড়ার প্রস্তুতি চলে সমান তালে। উৎসবে এ শহরটি জনশূন্য হয়ে পড়ে। ‘জ্যাম নেই, জ্যাম নেই’’ আওয়াজে অনেকের উল্লাস। ঢাকা যেন এক বৃহৎ ইপিজেড। মাইনে হলেই এ শহর ছাড়তে হবে। উৎসবে জনশূন্য নগর প্রমাণ করে তো এই। এটি কামানোর জায়গা। রাজধানীর আপনজন নেই। ঈদের শহর ফাঁকা এতিম হয়ে সে দৃষ্টান্ত দেখায়।
যারা ঈদে শহর ছাড়বেন তাদের দোষ কী? এ ফেরা তো দম নেয়ার জন্যই। মাকে দেখা। বাবাকে দেখা। গতবার লাগানো নিম গাছটা ছোঁয়া। কোভিড স্বাস্থ্যবিধি উড়ে পালাবে মায়ের বুকের কাঠালচাঁপা ঘ্রাণের টানে।
রিকশাচালকেরা ঈদে খুব খুশি। সব রাস্তায় চলা যাচ্ছে। ভিআইপি, সিআইপি কিছু থাকে না এ টাইমে। তারা ঘাম মোছে আর টাকা গোনে। ঈদে তো তারাও ফিরবে ঘরে। হয়তো মধ্যবিত্তের চেয়ে একটু পরে।
ঈদে পার্বণে শুধু শহর না, দেশ ছাড়েন এমন লোকও প্রচুর। অগণন কোটিপতি পয়দা হয়েছে এ দেশে। ছুটি পেলেই তারা এই ‘‘আবর্জনার’’ শহর ছাড়েন।
কোভিড উত্তর লাইফ সাপোর্ট ছেড়ে এবার জীবনে ফেরা তাড়া। সবখানে গতি আর ক্ষীপ্রতা। এর সাথে মেলাতে পারলে থাকো। নইলে বিদায়। এমন একটা ভাব সব দিকে। কিন্তু গত আকালের মৃত্যুকে মুছে আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ- এমন কি বলা যায়?
জনসংখ্যার বিরাট একটি অংশ মহামারির ছোবলে বহু কিছু হারিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা সামাজিক অবস্থান হারিয়েছে। তাদের এখন টিসিবি’র ট্রাকে লাইন দিতে হয়। সুবিধা হচ্ছে মুখ ঢাকা থাকছে মাস্কে। কায়দা করে বাঁচার সময় এখন। কিন্তু এ বাঁচা কি শিরদাঁড়া উঁচু করে? না কি মরি মরি বেঁচে থাকা? খুব সামনেই এর উত্তর মিলবে। তবু অস্তিত্ব রক্ষায় মানুষ লড়বে।
ফসলবিহীন মন কাঁদালেও এ প্রজাতি লড়তে জানে। মন্দা কাটানো সেই রক্তিম প্রভাতের অপেক্ষায় আমরা।
লেখক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা হাসান শাওনের জন্ম, বেড়ে ওঠা রাজধানীর মিরপুরে। পড়াশোনা করেছেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বাঙলা কলেজ, বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে। ২০০৫ সাল থেকে তিনি লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। কাজ করেছেন সমকাল, বণিক বার্তা, ক্যানভাস ম্যাগাজিন ও আজকের পত্রিকায়।
২০২০ সালে ১৩ নভেম্বর প্রকাশিত হয় হাসান শাওনের প্রথম বই “হুমায়ূনকে নিয়ে”।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত। ঢাকা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ এর জন্য দায়ী নয়।