সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের মানিসক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। শুধু মেয়েরা নয়; ছেলেরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তবে সেসব ঘটনার বেশিরভাগ প্রকাশ পায় না জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষণের ভুক্তভোগী ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্যই মানসিক স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রবিবার (১৬ মার্চ) ঢাকায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সম্মেলন কক্ষে “ধর্ষণ: শিশু-কিশোর মনে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ প্রভাব” শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডলসেন্ট মেন্টাল হেলথ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ধর্ষণের ভুক্তভোগীরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে পারেন।
ধর্ষণের ভুক্তভোগীরা বিষণ্নতা, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি), সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা, মাদকাসক্তির মতো ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এছাড়া শিশু-কিশোরদের মধ্যে দেখা দিতে পারে আচরণগত পরিবর্তন।
তবে নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগলেও ভুক্তভোগীরা চিকিৎসার জন্য আসেন না। ধর্ষণের ভুক্তভোগীর মধ্যে মানসিক চিকিৎসা নেওয়ার হার এক শতাংশের কম বলে জানান মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডলসেন্ট মেন্টাল হেলথের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, “ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি সাধারণত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে আসেন না, যতদিন না তাদের ধর্ষণ পরবর্তী মানসিক সমস্যার শুরু হয়। সেক্ষেত্রেও দেখা যায় যে, তারা তাদের সাথে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনাটি একেবারেই প্রকাশ করেন না বা শুরুতে প্রকাশ করতে চান না। পেশাগত দায়িত্ব থেকে আমাদের উচিত জনসচেতনতা তৈরি করা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৮.৩% মানুষ মানসিক রোগী। তাই অপরাধী মানেই মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত এই মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে হবে।”
অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমে ধর্ষণের খবর আসার প্রতি জোর দেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মো. মাহবুবর রাহমান। তবে ধর্ষণের ঘটনা যেন মুখরোচক সংবাদে পরিণত না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।
ডা. মো. মাহবুবর রাহমান “অপরাধী যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়, সে বিষয়টি আগে নিশ্চিত করা জরুরি। তবে ধর্ষণের ঘটনা যেন কোনোমতেই যেন মুখরোচক সংবাদে পরিণত না হয়। সাধারণত দেখা যায়, যারা এ ধরনের নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে যায়, তাদের পরবর্তীতে বিষণ্ণতা, পিটিএসডি, রেপ ট্রমা সিনড্রোম ইত্যাদি মানসিক সমস্যায় ভোগেন।”
ধর্ষণ প্রতিরোধে পরিবার ও সমাজের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সাইকিয়াট্রিস্টস-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. মো. নিজাম উদ্দীন বলেন, “এখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। রাষ্ট্র যদি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে পারে, তবে ধর্ষণের হার কমবে। মানুষের মাঝে অনুকরণের প্রবণতা থাকে। যার ফলশ্রুতিতে দেখা যায় ধর্ষণের ধরন বা ঘটনার রগরগে বর্ণনাতে সম্ভাব্য অপরাধীরা উৎসাহিত হয়। তাই অপরাধের বর্ণনাকে প্রাধান্য না দিয়ে অপরাধী যেন শাস্তি পায়, সে ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।”
সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাহিদ মাহজাবিন মোর্শেদ বলেন, “শুধু মেয়েরাই নয়, অনেক ছেলে শিশুরাও তার বন্ধু, শিক্ষক বা আপনজন দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের ঘটনা আমাদের কাছে আসে না।”
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডলসেন্ট মেন্টাল হেলথের সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. রাহানুল ইসলাম বলেন, “ধর্ষণের ক্ষেত্রে অপরাধী এবং ভিক্টিমের মধ্যকার সম্পর্কের চেয়ে সংগঠিত অপরাধের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ কোনোভাবে যখন প্রচার মাধ্যমে সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, তখন আন্তঃসম্পর্কগুলোতে তার প্রভাব পড়ে এবং এক্ষেত্রে অনেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।”
ধর্ষণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটার মূল কারণ বিচারহীনতা উল্লেখ করে চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. মাহাবুবা রহমান বলেন, “এজন্য আমাদের আগে সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে। রেপ কালচার, যেমন ব্যাড টাচ (খারাপ স্পর্শ) ধর্ষণের ঘটনাকে প্ররোচিত করে।”
চাইল্ড এন্ড এডোলোসেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. নুসরাত জাহান তানজিলা বলেন, “ধর্ষণ পরবর্তী সময়ে ভুক্তভোগী নানা রকম মানসিক সমস্যা যেমন বিষণ্ণতা, পিটিএসডি, রেপ ট্রমা সিন্ড্রোমসহ নানা রকম মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়। বিষয়গুলো ভীষণভাবে অবহেলিত হওয়ায় এসব ঘটনা অগোচরে থেকে যায়। আজকের প্রেস কনফারেন্সের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে জানানো যে, আমরা মনোরোগবিশেষজ্ঞরা তাদের এই মানসিক স্বাস্থ্যের সহায়তা প্রদানে সর্বদা প্রস্তুত।”
সংবাদ সম্মেলনে ধর্ষণের ঘটনায় শিশু-কিশোর মনে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ প্রভাব বিষয়ে দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডা. শবনম সাবা ও ডা. নিশাত তামান্না নূর।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ধর্ষণের ভুক্তভোগীদের বিনামূল্যে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে বলেও সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়।