Friday, June 20, 2025

সেকশন

English
Dhaka Tribune

বন্ধ হচ্ছে না ‘মব সন্ত্রাস’, বাড়ছে আতঙ্ক-উদ্বেগ

  • আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত গণপিটুনিতে অন্তত ১১৯ জন নিহত হয়েছেন
  • ছয় মাসে পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার ২২৫টি ঘটনার মধ্যে ৭০টি ছিল বড় ধরনের
আপডেট : ১৯ মে ২০২৫, ০৩:৩৭ পিএম

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী শাহারিয়ার আলম সাম্যকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় গত ১৩ মে রাতে। সাম্য ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই ঘটনায় পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।

এরা হলেন- তামিম হাওলাদার (৩০), পলাশ সরদার (৩০) ও সম্রাট মল্লিক (২৮)। এদের মধ্যে তামিম আর পলাশ ফুটপাতে ব্যবসা করতেন। সম্রাট করতেন শ্রমিকের কাজ। তাদের গ্রেপ্তারের খবরে বুধবার মাদারীপুর সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের ব্রাহ্মন্দী এলাকার তামিমের গ্রামের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় একদল মানুষ।

১৭ মে এই তিনজনকে আদালতে হাজির করা হলে তামিম আদালতে বলেন, “আমরা যদি খুনের সঙ্গে জড়িত থাকতাম তাহলে তো পালিয়ে যেতাম। ওইখানে তো আর বসে থাকতাম না।”

পুলিশও বলছে, তাকে ধরা হয়েছে সন্দেহভাজন হিসেবে। কিন্তু এরই মধ্যে তামিমের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যেখানে তার বাবা-মাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও বাস করতেন।

প্রশ্ন উঠেছে, যারা মব তৈরিতে যারা জড়িত, তাদের কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ব্যাপারে কী করছে?

খোদ পুলিশই মবের শিকার

পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, “শুধু পুলিশের একার পক্ষে মব বন্ধ করা কঠিন। এখানে সবার সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। অভ্যুত্থানের ৯ মাস পরও পুলিশের বিরুদ্ধেই প্রতিদিন গড়ে একটার বেশি মব হচ্ছে। সর্বশেষ এপ্রিলে পুলিশের বিরুদ্ধেই ৩৭টি মব হয়েছে এবং মার্চে ৩৫টি। এই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পুলিশ কোনো আসামি গ্রেপ্তারের পর একদল মানুষ সংগঠিত হয়েছে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে বা পুলিশের ওপর হামলা করে আসামি ছিনিয়ে নিতে চাইছে। তবে এইসব ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সবাই মিলে চেষ্টা করলে পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব।”

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার ২২৫টি ঘটনার মধ্যে ৭০টি ছিল বড় ধরনের আক্রমণ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২৪টি, অক্টোবরে ৩৪, নভেম্বরে ৪৯, ডিসেম্বরে ৪৩, জানুয়ারিতে ৩৮ এবং ফেব্রুয়ারিতে ৩৭টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।

পুলিশের এই পরিসংখ্যানের বাইরেও সড়কে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বিরূপ আচরণের বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে।

ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মব তৈরি করে হামলাগুলো করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেশাদার অপরাধী ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও মব তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন। এই মব তৈরি করে শুধু পুলিশের ওপরেই হামলা হচ্ছে তা নয়, বরং কোথাও কোথাও সাধারণ মানুষের ওপরও হামলা বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, “পুলিশ যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন তাদের ওপর হামলা, হুমকি ও আসামি ছিনতাই বাহিনীটিকে নতুন সংকটে ফেলছে। অনেক ঘটনার নেপথ্যে রাজনৈতিক আশীর্বাদ রয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা অপরাধীদের রক্ষা করতে পারেন এমন ধারণা কোনোভাবেই গড়ে উঠতে দেওয়া যাবে না। এ ধরনের ঘটনায় নতি স্বীকার না করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশকে আরও কঠোর হতে হবে।”

গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা বাড়ছে

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসাবে, ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত গণপিটুনিতে অন্তত ১১৯ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৭৪ জন। গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মোট ৭৯২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালে। গত বছর এ ধরনের ঘটনায় ১৭৯ জন নিহত হয়েছেন।

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা বেড়েছে।

দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থকদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া নানা স্থানে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত দেশের ৪৯ জেলায় হামলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তত ১ হাজার ৬৮টি ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এসব ঘটনা ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ পত্রপত্রিকায় “মব” ও “মব জাস্টিস” শব্দ দুটি আলোচনায় রয়েছে। ইংরেজি শব্দ “মব”-এর অর্থ “উচ্ছৃঙ্খল জনতা”। আর সরল ভাষায়, এই বিশৃঙ্খল জনতা নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে সহিংসতা করলে তাকে “মব জাস্টিস” বা “উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার” বলা হচ্ছে।

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় গত ৪ মার্চ ছিনতাইকারী তকমা দিয়ে ইরানের দুই নাগরিককে মারধর করে একদল ব্যক্তি। এতে ওই দুজন আহত হন। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।

পুলিশের ভাষ্য, ইরানের এই দুই নাগরিক ছিনতাইকারী ছিলেন না। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তারা। একপর্যায়ে ছিনতাইকারী তকমা দিয়ে তাদের মারধর করা হয়।

বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, “মবের এই সংস্কৃতি অত্যন্ত উদ্বেগের। সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না। দেখেন, ছাত্ররা যমুনার সামনে গিয়ে বা শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে এক ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিচ্ছে। সরকার দ্রুত বৈঠক ডেকে তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে।”

তিনি মনে করেন, “পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে সরকারের ওপরও সরকার আছে। এভাবে চললে আপনি আইনের শাসন বাস্তবায়ন করবেন কিভাবে?”

কাজী রিয়াজুল হক বলেন, “ড. ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি যখন দেশের দায়িত্ব নিলেন তখন সবার মধ্যে এক ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেই প্রত্যাশা কি পূরণ করতে পারছেন? আমি মনে করি, সরকারকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে শক্ত হতে হবে।”

বগুড়া হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এস এম মিল্লাত হোসেনকে মারধর করে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ৫ মে দিবাগত রাতে বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকায়/ঢাকা ট্রিবিউন

সম্প্রতি মবের আরও কিছু ঘটনা

বগুড়া হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এস এম মিল্লাত হোসেনকে মারধরের পর পুলিশে সোপর্দ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাকর্মীরা। ৫ মে রাত ৮টার দিকে বগুড়া শহরের ইয়াকুবিয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয় মার্কেটের নিজ চেম্বার থেকে এস এম মিল্লাতকে আটকের পর মারধর করা হয়েছে। এস এম মিল্লাত স্বাধীনতা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক পরিষদ বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদ বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। তিনি বগুড়া শহরের নাটাইপাড়া এলাকায় বসবাস করেন।

এই ঘটনায় নেতৃত্ব দেন এনসিপির শ্রমিক উইংয়ের কেন্দ্রীয় সংগঠক আবদুল্লাহ আল সানী। স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে তিনি দাবি করেছেন, “গত ১৫ বছর এস এম মিল্লাত ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন। নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। মিল্লাত টাকা নিয়েও চাকরি দেননি। ৫ আগস্টের পর মিল্লাত ফেসবুকে অপপ্রচার চালাচ্ছেন, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে নানাভাবে সহায়তা করছেন।”

কাউকে আটক করে পুলিশের দেওয়ার দায়িত্ব তাদের কি-না? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, “পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলেই তারা এটা করেছেন।”

এর আগে ২৯ এপ্রিল অভিনেতা সিদ্দিককে রাস্তায় মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এই ঘটনার একাধিক ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভিডিওতে দেখা যায়, জামাকাপড় ছেঁড়া অবস্থায় তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে একদল যুবক। কেউ তার গায়েও হাত তুলছিলেন, অভিনেতা সিদ্দিক কান্নাকাটি করছিলেন। অভিনয়শিল্পীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে স্লোগান দেয়া হচ্ছিল।

জামাকাপড় ছেঁড়া অবস্থায় রাস্তায় হাঁটিয়ে সিদ্দিককে রমনা থানা–পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়/ভিভিও থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট

জামাকাপড় ছেঁড়া অবস্থায় রাস্তায় হাঁটিয়ে সিদ্দিককে রমনা থানা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সিদ্দিক অভিনয়ের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একাধিকবার ঢাকার গুলশান ও টাঙ্গাইলের মধুপুর আসন থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তবে তিনি মনোনয়ন পাননি।

মবের ভয়ে ‘সেলফ সেন্সরশিপে’ গণমাধ্যম

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সময়ে সংবাদমাধ্যমের ওপর সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার “হস্তক্ষেপ বন্ধ” হলেও “মবের” হুমকির নতুন প্রবণতা দেখার কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তৈরি করা গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ।

সম্প্রতি বাংলাদেশের গণমাধ্যম বিডিনিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “মবের হুমকির কারণে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরনের সংশয়ে আছে; ফিরে এসেছে সেলফ সেন্সরশিপ।”

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহমেদ বলেন, “মবের প্রেক্ষাপটটা আগে দেখতে হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মানুষ কোনো ধরনের ন্যায্য দাবি জানাতে পারেনি। ফলে অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। কিছু জায়গায় এই ধরনের মব হচ্ছে, কিন্তু সেগুলোর বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না তা কিন্তু নয়।”

তিনি বলেন, “কিছুদিন আগে গুলশানে একটি বাড়িতে আওয়ামী লীগের এক নেতার টাকা লুকানো আছে বলে প্রচার করে সেই বাড়িতে জনতা তল্লাশি চালায়। সেখানে কিন্তু পুলিশ খোঁজ নিয়ে জেনেছে এই ঘটনার সঙ্গে ওই বাড়িতে কাজ করতেন তারাই জড়িত। পরে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আবার ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আন্দোলনের সময় সিলেটসহ বেশ কিছু জায়গায় কিছু প্রতিষ্ঠানে লুটপাট হয়েছে। তখন কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ৬০-৭০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা স্বীকার করি, পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি, তবে এই অপরাধ শূন্যে নামিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।”

   

About

Popular Links

x