তনুহীনতার ৬ বছরে কারো মনে পড়বে জীবনানন্দ দাশের মৃত মাংস কবিতাটির কথা।
“ডানা ভেঙে ঘুরে-ঘুরে প’ড়ে গেলো ঘাসের উপর;
কে তার ভেঙেছে ডানা জানে না সে ; - আকাশের ঘরে
কোনোদিন-কোনোদিন আর তার হবে না প্রবেশ?. . .”
কারও মনে পড়তে পারে পিট সিগার।
“ Where have all the flowers gone?
Long time passing.
Where have all the flowers gone?
Long time ago.
Where have all the flowers gone?
The girls have picked them every one.
Oh, When will you ever learn?
Oh, When will you ever learn?
Young girls
They've taken husbands every one.
Young men
They're all in uniform.
Soldiers
They've gone to graveyards every one.
Graveyards
They're covered with flowers every one.
Flowers
Young girls have picked them every one. ”
কিন্তু যাদের মন বলে কিছু নেই, তাদের কথা কী বলি? বাস্তবতা তো এই যে, তনু ডাকনামের সোহাগী জাহান আমাদের মন থেকে বিস্মৃত হতে চলেছেন। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকা থেকে এই ১৯ বছর বয়সী মেয়েটির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। তার মরদেহে ধর্ষণের পর হত্যার আলামত ছিল এটি পুলিশ তখন জানায়।
নাট্যকর্মী তনু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ছিলেন। সেনানিবাসের একটি বাসায় তিনি টিউশনি করতেন। সেই বাসার পাশের এক ঝোপে তার মরদেহ পাওয়া যায়। গত ৬ বছরেরও যে খুন ও ধর্ষণের বিচার হয়নি।
মেয়ের লাশ পাওয়ার পর কুমিল্লা শহরের কোতোয়ালী মডেল থানায় অজ্ঞাত আসামির বিরুদ্ধের তনুর বাবা ইয়ার হোসেন একটি মামলা দায়ের করেন। রহস্যজনকভাবে তনুর মৃতদেহের প্রথম ময়নাতদন্ত ঘটনাস্থল কুমিল্লায় হয় না। সেটি হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। পুলিশ মামলাটি গোয়েন্দা বিভাগে পাঠায়। ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল এ মামলা সিআইডির কাছে হস্তান্তরিত হয়। প্রাণহীন নাট্যকর্মী তনুর মরদেহ নিয়ে যেন নাটকীয়তার শুরু। ৪ এপ্রিল প্রকাশিত ময়নাতদন্তে প্রতিবেদনে বলা হয়, তনুকে ধর্ষণ কিংবা হত্যার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। সে ময়নাতদন্ত দেশজুড়ে বিতর্কের মুখে পড়ে। উচ্চ আদালত পুনরায় ময়নাতদন্তের রায় দেন। আদালতের রায়ে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে হয়। তা প্রকাশ হলে ধর্ষণের আলামত শনাক্ত হয়। ২০১৬ সালের মে মাসে সিআইডির তত্ত্বাবধানে তনুর পরিহিত অন্তর্বাসে প্রাপ্ত বীর্যের ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। সিআইডি নিজস্ব গবেষণাগারে তিনজন পুরুষের বীর্যের অস্তিত্ব তাতে পাওয়া যায়।
এর মানে দাঁড়ায়, ১৯ বছরের এই মেয়েটি মৃত্যুর আগে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর মৃত্যুর পর মির্জাপুরের কবরে তার চিরঘুম শান্তির হয়নি। চলেছে দফায় দফায় সে কবর খুঁড়ে উঠিয়ে ময়নাতদন্ত। তাতেও তার আত্মা হয়তো প্রশান্ত হতো তবু যদি বিচার মিলত!
সংবাদমাধ্যমে ২০১৮ সালের ৫ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, “কুমিল্লায় কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর খুনের মামলাটি বর্তমানে উচ্চতর পর্যায়ে তদন্তাধীন রয়েছে। শিগগিরই সেটি আলোর মুখ দেখবে।”
সে আলো কোন চোরাপথে হারিয়েছে আমরা জানি না।
২০১৮ সালে ২১ মার্চ বিবিসি বাংলা’র এক প্রতিবেদনে পড়ি, “বাংলাদেশের কুমিল্লায় কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন নিহতের পরিবার।
হত্যাকাণ্ডের দু'বছর পর তনুর বাবা ইয়ার হোসেন বলেছেন, বিচারে কোন অগ্রগতি তো হয়ই নি, বরং অভিযোগ করেছেন যে তিনি ও তার পরিবার নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
ইয়ার হোসেন এক সাক্ষাৎকারে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "বিচার এখনো কিচ্ছু এগোয়নি। সব আর্মি তো আমার মেয়েটাকে মারে নাই। আমি সব আর্মির কথা বলছি না। আমি বলি যে মারছে তার বিচারটা করেন"।
তিনি আরও বলেন, "আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে একটু সাক্ষাৎ করতে চাই। তারা খালি আমার পরিবারকেই হয়রানি করছে।”
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সীমাহীন নারী নিপীড়নের ক্ষত সহ্য করে। স্বাধীন দেশেও নারীর ভাগ্য বদল হলো না। তাও নারী নেতৃত্বকালে। ৯০ সালের পর বিএনপি শাসনামলে দিনাজপুরে পুলিশের দ্বারা ইয়াসমীন হত্যার ঘটনা ঘটে। পুলিশী হেফাজতে সীমা নামে এক নারী ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটে। মনে পড়ে যায়যায়দিন শিরোনাম করেছিল “সীমা হত্যার সীমা লঙ্ঘন!”
৯৬ সালের পর আওয়ামী লীগ শাসনামলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা ধর্ষণে সেঞ্চুরিয়ান মানিকের নাম সংবাদমাধ্যমে আসে। ক্যাম্পাস থেকে দেশজুড়ে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে ওঠে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে। কিন্তু এর বিচার কতটুকু হয়েছে কে জানে?
আমাদের দেশের সব কর্তৃত্ববাদী দলের যৌথতা দেখি নারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার বেলায়। আমাদের মায়েদের, বোনেদের, বন্ধু, স্বজনদের তাই সয়ে যেতে হচ্ছে। অনিচ্ছার যৌনতাই বোধ হয় বেশি উপভোগ্য এই পুরুষতন্ত্রের কাছে।
মনেহয় এ সময়ে তনু খুন, ধর্ষণ ও এর বিচারহীনতা প্রসঙ্গ উত্থাপনে কী লাভ? ক্ষমতার চিহ্নিত স্নেহভাজনদের দাওয়াতে সানি লিওনির নাচ হচ্ছে যখন মোস্ট ভিউড কনটেন্ট ! পুরুষতান্ত্রিকতার সর্বোচ্চ এ প্রহরে সকল নারীই যেন ইচ্ছুক নারীর প্রতিমূর্তি।
নারী ধর্ষণ ও খুনের মতো ঘৃণ্য অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে হয়তো পরিস্থিতি বদলাতো। দুঃখজনক হলেও তা হয়নি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ১,৩২১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন নয়জন। “মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২১” পর্যালোচনায় গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনের এই তথ্য তুলে ধরে আসক।
এই পরিস্থিতিতে আমরা বিচার না চেয়ে বরং কবরে শান্তি চাই। অন্তত তনুর পরিনতি চাই না। নতুন স্লোগান হোক - “চিরঘুম দীর্ঘজীবী হোক!”
লেখক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা হাসান শাওনের জন্ম, বেড়ে ওঠা রাজধানীর মিরপুরে। পড়াশোনা করেছেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বাঙলা কলেজ, বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে। ২০০৫ সাল থেকে তিনি লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। কাজ করেছেন সমকাল, বণিক বার্তা, ক্যানভাস ম্যাগাজিন ও আজকের পত্রিকায়।
২০২০ সালে ১৩ নভেম্বর প্রকাশিত হয় হাসান শাওনের প্রথম বই ''হুমায়ূনকে নিয়ে''।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত। ঢাকা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ এর জন্য দায়ী নয়।