আমাদের বিপ্লবোত্তর জনগণের সরকার একদল বঞ্চিত সরকারি আমলাদের ভুতাপেক্ষ পদোন্নতি দান করেছেন। তারা নিশ্চয়ই ভাবছেন যে তারা একটি মহান এবং বিপ্লবী কাজ করেছেন। হয়তো আমজনতাও তাই ভাবতে পারতেন। আমার ধারণা, আমার মতো আমজনতার অনেকেই এ ধরনের একটা সিদ্ধান্ত কে সরকারের একটি অন্যায্য কাজ হিসেবেই দেখবে। অনেক কারণে।
সরকারকে কেন এই পুরস্কার দিতে হল সেটা প্রথমে দেখা যেতে পারে। পূর্ববর্তী ফ্যাসিবাদী সরকারের রোষানলে পড়ে অনেকেই হয়তো বঞ্চিত হয়েছেন। বঞ্চনা এবং তার ব্যাপ্তি ভেদে একজন আবেদন করতেই পারেন এবং তার প্রতিকার চাইতেই পারেন; এবং সে অনুযায়ী সরকার প্রতিকার করতেই পারে। একজন মজলুম হিসেবে আবেদন করলে রাষ্ট্র সেটা বিবেচনা করে প্রতিকার করবে সেটা তো একটা ন্যায্য কাজ। সরকার হয়তো ভাবছে বা দেখাচ্ছে তারা সেটাই করেছে এবং এটি একটি ভালো কাজ।
একটি স্বাভাবিক অবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পরে রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিত একদল আমলাকে এভাবে বিবেচনা হয়তো আগেও করা হয়েছে। আগামীতেও হবে। কিন্তু একটি বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে যেখানে লাখ লাখ জনতা বিভিন্নভাবে বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিষ্পেশিত হয়েছে, জীবন দিয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, সহায় সম্পদ হারিয়েছে, ইজ্জত হারিয়েছে, অপমানিত হয়েছে সে রকম একটা পরিস্থিতিতে সরকার যদি ক্ষমতা কাঠামোয় ওপরে থাকার কারণে, তাদের খুশি রাখার প্রয়োজনে শুধুমাত্র একদল আমলাকে পুরস্কৃত করতে চায় তাহলে সেটাকে আমজনতা একটা বড় ধরনের পক্ষপাত এবং অন্যায্য হিসেবে বিবেচনা করতেই পারে।
ক্ষমতা কাঠামো বিবেচনায় সরকারি আমলারা অবশ্যই সামনের সারিতে আছেন। তারা সরকারকে সরাসরি সাহায্য করেন, সাহায্য না করে বিপদেও ফেলতে পারেন, এবং অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে ষড়যন্ত্রও করতে পারেন। এ সবই যদি কারণ হয়ে থাকে তাহলে বলতে হবে সরকার নিজেকে এদের হাতে জিম্মি ভাবছে। ভাবছে কোনোভাবে এই বিশেষ শ্রেণিকে সন্তষ্ট করতে পারলে তারা নির্ভার থাকতে পারবে। কিন্তু বিষয়টি এত সহজ হবে না। ষড়যন্ত্র চলতেই থাকবে; একটার পর একটা, নানা পথ ধরে। এর কিছু নমুনা আমরা দেখেছি ইতোমধ্যে সচিবালয়ে দলাদলি, মারপিট, ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
এই কাজের মাধ্যমে সরকার স্বীকার করে নিলো যে শুধুমাত্র আমলারাই বঞ্ছিত হওয়ার অধিকার রাখে রাষ্ট্রের বিবেচনায়। বাকি সব কন্টিঞ্জেন্সি। জনতা চাকরি হারিয়েছে, কাজ হারিয়েছে, ব্যবসা বাণিজ্য, ভিটে-বাড়ি বেচেছে, কোর্ট-কাচারিতে সর্বস্ব হারিয়েছে, পঙ্গুত্ব এড়াতে চিকিৎসায় সব হারিয়েছে, গুম হয়েছে, নির্বাসিত থেকেছে, জমানো সম্পদ হারিয়েছে। শুধুমাত্র ভিন্নমত প্রকাশের কারণে কতজন যে কতভাবে বঞ্ছিত হয়েছে সেগুলো আমরা কে না জানি? এরা কীভাবে রাষ্ট্রের কাছে আর্জি করবে, তাদের বঞ্চিত হওয়ার হিসেব দেবে, প্রতিকার দাবি করবে; এই আমলারা বা এই সরকার কি তার কোন সদুত্তর দিতে পারবে?
একটা বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে সব বঞ্চিত নাগরিক সমান। তাদের সবাইকে সমানভাবে দেখতে হবে। ব্যক্তি বঞ্ছনার ব্যপ্তিভেদে তাদের প্রতিকার করা যেতে পারে। কোনো শ্রেণিভেদে নয়। আমাদের দায়িত্ব হবে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এই সরকার এর সূত্রপাত করতেই পারতো। পথ বাতলে দেওয়ার কাজ করতে পারতো। উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারত। আমলারাও বলতে পারতেন, তারা কোনো ব্যতিক্রম নন; অন্যসব বঞ্চিতদের মতো তারাও একপক্ষ। আরও লাখ লাখ বঞ্ছিতের মধ্যে তারা সাত কিংবা আটশ জন মাত্র। সবার কথা যখন বিবেচনা করা হবে তখন যেন তাদের পাওনাটাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সবাই অংশীজন, সবাই বঞ্চিত।
এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমাদের আরেকটি দায়িত্বের কথা। আমরা এখনও ভাবছি কিন্তু রাষ্ট্রের মালিকানা কার সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা করতে পারছি না। আমরা আমলাদের সন্তুষ্ট করছি সর্বাগ্রে, জনগণের কথা ভাবছি না। আমলারাও ভাবছে জনগণ তাদের জীবনভর স্যার ডাকতে থাকবে, রাষ্ট্রের চাকর হয়েও মালিকের মতো করে তারা তাদের গাড়িতে ফ্লাগস্ট্যান্ড লাগাবে, গাড়িতে অদ্ভুত বিকট শব্দের সব হর্ন বাজাবে, ব্যক্তিগত গাড়িতে তার অফিসের লোগো ব্যবহার করবে, ভিআইপি সুবিধা নেবে, সস্তা সুদহারে গাড়ি কেনার টাকা পাবে, ব্যক্তিগত কাজে অফিসের গাড়ি ব্যবহার করবে। এই ব্যবস্থা চলতে থাকবে জন্মজন্মান্তর। বিপ্লব হবে এবং তারা তাদের বঞ্চিত হওয়ার ফিরিস্তি দিয়ে হারানো সব পাওনা চুকিয়ে নেবে, এবং তারপরেও বলবে তারা পাবলিক সার্ভেন্ট; এবং এর অনুবাদ করবে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা।
আর আমরা আমজনতা এর সব ন্যারেটিভ মেনে নিয়ে বিপ্লব করতে থাকবো, প্রান দিতে থাকবো, তাদের বঞ্চিত হওয়ার প্রতিকার করতে বাড়তি কর দিব, বিনাবাক্য ব্যায়ে এবং জীবনভর স্যার ডাকতেই থাকবো। বহাল থাকবেআমলা তান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা!