সরকারি চাকরিতে প্রবেশের স্বপ্ন দেখা হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর জন্য বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) এক কাঙ্ক্ষিত পরীক্ষা। কিন্তু ৪৪তম বিসিএস-এর বর্তমান পরিস্থিতি এবং সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ার সামগ্রিক চিত্র বেকার যুবকদের মধ্যে নতুন করে হতাশা তৈরি করেছে। একদিকে যেমন ৪৪তম বিসিএস-এ ভাইভার জন্য উত্তীর্ণ প্রার্থীর সংখ্যা বিপুল, অন্যদিকে পদের সংখ্যা সীমিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারি দফতরগুলোতে ৫০ হাজারেরও বেশি শূন্য পদ থাকার খবর, যা পূরণে দৃশ্যমান কার্যক্রমের অভাব রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন দপ্তর থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ৪৪ বিসিএসের জন্য অধিযাচন করে অনেক ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার পদ পাঠিয়েছে কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়, জনপ্রশাসন এবং পিএসসি এই ৩ পক্ষের সমন্বয় এবং অনিচ্ছার কারণে এই পদ্গুলো যোগ হবে কি-না তা নিয়ে সংশয়ের কারণে তরুণদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
৪৪তম বিসিএস-এর লিখিত পরীক্ষায় ১১,৭৩২ জন প্রার্থী উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। অথচ এই বিসিএসে ক্যাডার পদ রয়েছে মাত্র ১,৭১০টি। অর্থাৎ, প্রতি ছয়জনেরও বেশি লিখিত উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে কেবল একজন ক্যাডার হওয়ার সুযোগ পাবেন। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, প্রতিযোগিতা কতটা তীব্র। বিগত ৪০তম, ৪১তম এবং ৪৩তম বিসিএস-এ চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগে পদসংখ্যা কিছুটা বাড়ানো হলেও, ৪৪তম বিসিএস-এর ক্ষেত্রে (৩০ জুন সম্ভাব্য ফলাফল প্রকাশের তারিখ) এমন কোনো ইতিবাচক খবর না থাকায় প্রার্থীরা শঙ্কিত।
৩৮তম বিসিএসে পদ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪০০টি (মোট পদ ২০২৪টি), ৪১তম বিসিএসে পদ বৃদ্ধি পেয়েছে ৫২০টি (মোট পদ ২১৬৬টি), ৪৩তম বিসিএসে পদ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪০৪টি (মোট পদ ১৮১৬টি)। বর্তমানে চলমান বিসিএস গুলোর মধ্যে ৪৫তম বিসিএসে মোট পদ ছিল ২,৩০৯টি, ৪৬তম বিসিএসে ৩,১৪০টি এবং ৪৭তম বিসিএসে ৩,৪৮৭টি।
সরকারি দপ্তরগুলোতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ৫০ হাজারেরও বেশি পদ শূন্য রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ার কারণে এই শূন্য পদগুলো পূরণ হতে দীর্ঘ সময় লাগছে। একটি বিসিএস প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেই লেগে যায় কয়েক বছর। উদাহরণস্বরূপ, ৪৪তম বিসিএস-এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল ২০২১ সালের নভেম্বরে, এখন ২০২৫ সালের জুনে এসে এর চূড়ান্ত ফল প্রকাশের কথা। এই দীর্ঘসূত্রিতা কেবল প্রার্থীদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটায় না, বরং সরকারের কার্যক্রমেও স্থবিরতা সৃষ্টি করে।
বর্তমানে সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক সঙ্কট রয়েছে আর স্পেশাল বিসিএস আয়োজন করা সময় সাপেক্ষ। আর ২০০ মার্কের পরীক্ষা দিয়ে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকের থেকে ১,৫০০ মার্কের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষকদের মান অবশ্যই আলাদা হবে। পিএসসির কাছে শিক্ষায় দুই হাজারের বেশি পদ রয়েছে, এছাড়াও কলেজগুলোতে ১০ হাজারের বেশি শিক্ষকের চাহিদা রয়েছে। এ অবস্থায় ৪৪-এ শিক্ষা ক্যাডারে পদ বাড়িয়ে সমন্বয় করা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। (উল্লেখ্য, অন্যান্য বিসিএসের তুলনায় ৪৪-এ শিক্ষা ক্যাডারে পদ অনেক কম।)
৪৪তম বিসিএস-এ নন-ক্যাডার পদের সংখ্যা অত্যন্ত কম, মাত্র ১,৪০০-এর মতো। এর বেশিরভাগই কারিগরি প্রকৃতির পদ। এতে সাধারণ বিষয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের নন-ক্যাডার হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ আরও সীমিত হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি পিএসসি ৪৪তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য আবেদন আহ্বান করেছিলো কিন্তু প্রার্থীদের চাপে এই স্বল্পপদের আবেদনটি বাতিল করা হয়।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবিকে সামনে এনেছিল। সেই আন্দোলনের সূত্র ধরেই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করা হয়। বর্তমান সরকার এই আন্দোলনের ফলে ক্ষমতায় এসেছে, এমন একটি ধারণা জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত আছে। তবে, বেকার যুবকদের প্রত্যাশা ছিল, কোটা বাতিলের পর দ্রুত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিপুল সংখ্যক মেধাবী তরুণদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। ৫০ হাজারেরও বেশি শূন্য পদ থাকা সত্ত্বেও দৃশ্যত সেই প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না।
চাকরি প্রত্যাশীরা মনে করেন, সরকার যদি চলমান ৪৪তম ও ৪৫তম বিসিএস-এ এবং আসন্ন বিসিএস-এর মতো সার্কুলারগুলোতে সর্বোচ্চ সংখ্যক পদ বৃদ্ধি করে নিয়োগ দেয়, তাহলে ৫০ হাজারেরও বেশি শূন্য পদ পূরণের পাশাপাশি বেকার তরুণদের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার হবে। এছাড়া, প্রতি বছর ৯ম-১০ম গ্রেডে হাজার হাজার নতুন পদ তৈরি হচ্ছে। যদি প্রতিবছর একটি বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে এই পদগুলো পূরণ করা সম্ভব হয়, তাহলে দীর্ঘসূত্রিতা কমবে এবং বেকারত্ব নিরসনে এটি একটি টেকসই সমাধান হতে পারে। তরুণ প্রজন্মের চোখে, সরকারের উচিত এই বিপুল সংখ্যক বেকার মেধাবীদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। শুধু বিসিএস নয়, নন-ক্যাডার পদগুলোতেও দ্রুত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা এবং নিয়মিতভাবে নতুন পদ সৃষ্টি ও পূরণের মাধ্যমে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলতে পারে।