একটা সময় ছিল, যখন ইউরোপ মানেই ছিল মুক্তির আকাশ, সম্ভাবনার দিগন্ত। যুদ্ধের পরে ভেঙে পড়া দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ, দারিদ্র্যে জর্জরিত আফ্রিকার মানুষ কিংবা সামরিক শাসনে পিষ্ট আরব দেশগুলোর মানুষ ছুটে এসেছে এই মহাদেশে। কেউ এসেছে পিঠে ব্যাগ নিয়ে ছাত্র হতে, কেউ এসেছে ভারী কাজের গামছা বেঁধে শ্রমিক হতে, কেউ এসেছে নিপীড়নের হাত থেকে পালিয়ে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে। সবার চোখে ইউরোপ ছিল মানবিকতার আরেক নাম—যেখানে বর্ণ, ধর্ম, ভাষা, জাতিগোষ্ঠীর ভেদাভেদ ভুলে মানুষ বাঁচে। কিন্তু ইতিহাস শুধু এগোয় না, অনেক সময় পিছিয়েও যায়। সময় বদলায়, রাজনীতি বদলায়, আর সেই বদলের হাওয়া যখন অন্ধকারের দিকে যায়, তখন প্রথম ধাক্কাটা লাগে তাদের ওপর—যারা প্রান্তে থাকে, প্রবাসীরা, অভিবাসীরা, উদ্বাস্তুরা।
আজকের ইউরোপে যে রাজনৈতিক স্রোত বইছে, তা নিছক কোনো দলের উত্থান নয়, বরং একটি আদর্শগত ঘূর্ণাবর্ত। উগ্র ডানপন্থা একে একে দখল করে নিচ্ছে ইউরোপের দেশগুলোর পার্লামেন্ট, মন্ত্রিসভা, এমনকি জনগণের মন। পর্তুগালের “শেগা” দল এখন আর শুধু তৃতীয় শক্তি নয়, জাতীয় রাজনীতির প্রধান বিরোধী কণ্ঠ। ফ্রান্সে ম্যারিন লো পেনের “ন্যাশনাল র্যালি”, ইতালিতে জর্জিয়া মেলোনির “ব্রাদার্স অব ইতালি”, জার্মানিতে “আলটারনেটিভ ফর জার্মানি (আএফডি)”, অস্ট্রিয়ার “ফ্রিডম পার্টি”, হাঙ্গেরিতে ভিক্টর অরবানের “ফিদেজ”, নেদারল্যান্ডসে গির্ট উইল্ডার্সের “পার্টি ফর ফ্রিডম”; এই তালিকা দিনদিন দীর্ঘ হচ্ছে। তারা গণতন্ত্রের কাঠামো ভাঙছে না, কিন্তু সেই কাঠামোর ভেতর ঢুকে সেটাকে ভেতর থেকে বদলে দিচ্ছে।
এই ডানপন্থিরা বলছে, ইউরোপ এখন অভিবাসীদের কারণে বিপদের মুখে। তারা বলছে, বিদেশিরা আসছে, কাজ কাড়ছে, সংস্কৃতি নষ্ট করছে, অপরাধ বাড়াচ্ছে। এই কথাগুলো হয়তো একসময় ছিল উগ্র লোকজনের বারান্দার গালগল্প, কিন্তু আজ তা জাতীয় নির্বাচনের মঞ্চে উচ্চারিত হচ্ছে, সংসদে জোর গলায় বলা হচ্ছে, এমনকি সরকারি নীতিতে রূপ নিচ্ছে। শত্রু সৃষ্টি রাজনীতির এই পুরনো কৌশল নতুন মোড়কে ফিরে এসেছে—এবং এই শত্রু এখন অভিবাসী।
কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। ইউরোপের জনসংখ্যা দ্রুত বার্ধক্যের দিকে যাচ্ছে। তরুণ শ্রমশক্তির ঘাটতি দিনদিন বাড়ছে। হাসপাতাল থেকে শুরু করে নির্মাণ, কৃষি থেকে শুরু করে টেকনোলজি—সবখানে অভিবাসীরা আজ নির্ভরযোগ্য কর্মী। তারা শুধু শ্রম দিচ্ছে না, কর দিচ্ছে, অর্থনীতি সচল রাখছে, ভ্যাট দিচ্ছে, পেনশন ফান্ডে অবদান রাখছে। সেই মানুষগুলোকেই আজ দেখা হচ্ছে সন্দেহের চোখে, তাদের ঘিরে তৈরি হচ্ছে আতঙ্কের গল্প, গুজব, রাজনৈতিক অজুহাত। অথচ অভিবাসীরা চলে গেলে এই সমাজের চাকা থেমে যাবে, তা বুঝেও ইউরোপের অনেকের এই অন্ধতা—রাজনীতির বিষবাষ্পে সংক্রামিত এক মানসিক মহামারি।
এই উগ্র ডানপন্থার উত্থান শুধু রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক। এখন আর কেবল টেলিভিশনের বিতর্কে নয়, সাধারণ মানুষের আড্ডায়, স্কুলে বাচ্চাদের আচরণে, রাস্তায় চোখে পড়া মন্তব্যে, এমনকি প্রতিবেশীর মুখেও শোনা যাচ্ছে সেই ঘৃণার ধ্বনি। স্কুলে মুসলিম শিশুরা বর্ণবাদী কথা শুনছে, হিজাব পরা মেয়েরা রাস্তায় লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে, মসজিদে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। আইনের বইতে সহনশীলতার কথা লেখা থাকলেও বাস্তবতায় তার প্রয়োগ নেই। যাকে বলে, আইন আছে কিন্তু ন্যায়বিচার নেই।
পর্তুগাল এতদিন ছিল তুলনামূলক সহনশীল। কিন্তু ২০২৫ সালের নির্বাচনের পর রাজনৈতিক মানচিত্র বদলাতে শুরু করেছে। উগ্র ডানপন্থী শেগা পার্টি সংসদে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে এবং তারা জোর দিচ্ছে অভিবাসনবিরোধী এজেন্ডায়। তারা বলছে নাগরিকত্বের শর্ত কঠোর করতে হবে, বসবাসের শর্ত কঠিন করতে হবে, পারিবারিক পুনর্মিলনের সুযোগ সীমিত করতে হবে। এমনকি নতুন আইন আসতে চলেছে যেখানে নাগরিকত্বের জন্য ৫ বছরের বদলে ১০ বছর বসবাস করতে হবে, কঠিন ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে, আর কেউ কোনো গুরুতর অপরাধে জড়ালে নাগরিকত্ব পর্যন্ত বাতিল হতে পারে। এই ধরনের পদক্ষেপ কেবল প্রশাসনিক নয়, এটি একটি প্রতীকী বার্তা—তোমরা আমাদের মতো নও, তোমরা বাইরের মানুষ।
ফ্রান্সে ম্যারিন লো পেন অনেক আগে থেকেই এই ভাষা চালু করেছেন। তিনি চান ফ্রান্স হোক কেবল ফরাসিদের জন্য। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি নিজেকে এক ফ্যাসিবাদী ঐতিহ্যের ধারক মনে করেন, এবং তার সরকার ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আসা অভিবাসীদের ঠেকাতে সেনা মোতায়েন করছে, সাহায্যকারী সংগঠনগুলোর ওপর বিধিনিষেধ চাপাচ্ছে। জার্মানির আফডি নেতা যখন বলেন, “ইসলাম আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না”; তখন তা কেবল ধর্মীয় বিদ্বেষ নয়, বরং এক বিস্তৃত সাংস্কৃতিক বর্জনের ঘোষণা।
এই পরিস্থিতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা কোথায় দাঁড়িয়ে? তারা কোনো কল্পনার জগতে নেই—এই বাস্তবই তাদের চারপাশে। তাদের মধ্যে অনেকেই এখনো বিশ্বাস করে, বৈধ কাগজপত্র থাকলেই সব সমস্যার সমাধান। কিন্তু সময় এখন সেই ধারণা ভাঙার। সমাজের সত্যিকারের অংশ হতে হলে শুধু কাগজ নয়, দরকার ভাষা জানা, সংস্কৃতি বোঝা, নিয়ম মেনে চলা, স্থানীয়দের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলা। অনেকেই নিজেদের আলাদা মহল্লা তৈরি করে কাটিয়ে দিতে চায়, কিন্তু এই গেটো সংস্কৃতি দীর্ঘমেয়াদে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। স্থানীয় সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে, বৈধ হয়েও একদিন পরবাসী হয়ে যেতে হয়।
রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে হবে। শুধু ভোট নয়, বরং নিয়মিতভাবে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে হবে—স্কুলে, পৌরসভায়, কমিউনিটিতে, কর্মক্ষেত্রে। কেউ যখন নিপীড়নের শিকার হন, তখন তাকে একা ফেলে রাখলে সেই নিপীড়ন সবাইকে গ্রাস করবে। দূতাবাসের ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র পাসপোর্ট আর ভিসা দেওয়ার জায়গা নয়, প্রবাসীদের সংস্কৃতি, শিক্ষা, আইনগত সহায়তা, দক্ষতা উন্নয়নে দূতাবাসকে হতে হবে প্রকৃত সহায়ক।
সবচেয়ে জরুরি হলো, নতুন প্রজন্মকে প্রস্তুত করা। যারা আজ স্কুলে, তাদের মানসিক গঠনেই নির্ধারিত হবে আগামী ইউরোপে প্রবাসীদের অবস্থান। তারা যেন জানে—এই ঘৃণার রাজনীতি তাদের নয়। তারা যেন বোঝে, একজন নাগরিক হতে হলে শুধু জন্ম নয়, চাই মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, দায়িত্ববোধ। এই লড়াই দিনের নয়, দশকের—শুধু ভোটের নয়, সামাজিক সম্পর্ক আর সাংস্কৃতিক উপস্থিতির।
ইতিহাস বলে, ঘৃণার রাজনীতি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। হিটলার ছিলেন, নেই; মুসোলিনি ছিলেন, নেই; কিন্তু মানুষের অধিকার, ভালোবাসা, সহাবস্থানের আকাঙ্ক্ষা টিকে থাকে। আজ ইউরোপের আকাশে ঘন মেঘ, বিদ্বেষের গর্জন। কিন্তু সেই গর্জন চিরকাল থাকে না। প্রয়োজন সাহসের বাতি জ্বালিয়ে রাখা। প্রয়োজন হাতে হাত রেখে বলার—এই সমাজ আমাদেরও, আমরা পর নই।
এই ইউরোপ শুধু শ্বেতাঙ্গের নয়, এটি সেই সকল মানুষেরও—যারা কৃষিক্ষেতের মাটি কেটেছে, রেস্টুরেন্টে থালা ধুয়েছে, হাসপাতালের রোগী সেবেছে, কোড লিখেছে, ছাদ বানিয়েছে। এই সমাজের প্রতিটি ইট-পাথরে তাদের ঘামের ছাপ আছে। আমাদের দরকার সম্মিলিত চেতনা, দায়িত্বশীল নেতৃত্ব এবং একে অপরের প্রতি ভালোবাসা। কারণ আমরা কেউই এই পৃথিবীতে পর নই—আমরা সবাই মানুষের সন্তান। আর এই পৃথিবী, এই ইউরোপ, আমাদের সবার।