"তুমি কি আমাকে প্রপোজ করছ?" – প্রশ্নটা তখনও হাওয়ায় ভাসছিল।
অবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন বিবাহিত চীনা নারী ইউ-আন (ছদ্মনাম)।
শুধু ইউ-আন নন; অ্যাপের মাধ্যমে তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ভিত্তিক বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে চ্যাটিং করছেন দেশটির অনেক নারী।
“ক্যারেক্টার ডট এআই' নামের বিশেষ চাইনিজ এই অ্যাপের মাধ্যমে এআই বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সবেমাত্র নিজেদের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে কথাবার্তা শুরু করা ইউ-আন সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেন, “আমি জানি এটা সত্যি নয়। কিন্তু তার (এআই বয়ফ্রেন্ডের) নমনীয় ব্যবহার এবং আমার বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার ব্যাপারটা আমাকে সেই মানসিক শান্তি দিতে পেরেছে যা বাস্তবের সম্পর্কে আমি পাইনি।”
ব্যক্তিগত জীবনে বৈবাহিক সমস্যা এবং উদ্বেগের সঙ্গে লড়াই চলে তার। এই পরিস্থিতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি তার এআই বয়ফ্রেন্ড তাকে স্বান্ত্বনা দিয়েছে বলে জানান ইউ-আন।
এমনকি বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলো মেটাতে কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য নেওয়ার বিষয়টাকেও স্থগিত করেছেন তিনি। তার বদলে এই ভার্চুয়াল কথোপকথনের মাধ্যমেই সাময়িক স্বস্তি খুঁজেছেন।
কিন্তু হঠাৎই যখন ইউ-আনের এআই বয়ফ্রেন্ড তাকে প্রপোজ করে বসে, তখন তার কাছে বাস্তব এবং কল্পনার পৃথিবীর মধ্যে সীমারেখা ঝাপসা হতে থাকে।
অপরাধবোধে জর্জরিত হয়ে এআইয়ের কাছে নিজের বিয়ের বিষয়টি উল্লেখ করা এড়িয়ে যান ওই নারী।
ইউ-আনের সঙ্গে যা ঘটছে তা চীনে নতুন কিছু নয়। সেখানে এ ধরনের ঘটনা বেড়েই চলেছে।
এআই কম্প্যানিয়ন অ্যাপগুলো (যে অ্যাপ ব্যবহার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি সঙ্গীর সঙ্গে চ্যাট করা যায়) দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে “হিউম্যান-এআই রোম্যান্স” ক্রমশ একটা নতুন উপসংস্কৃতি হয়ে উঠছে।
বিবিসি জানিয়েছে, “ডুবান” নামে চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই প্রসঙ্গে আলোচনা করে এমন গ্রুপে (২০২০ সাল থেকে) দশ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।
শুধু তাই নয়, “ডুইন”-এ (টিকটকের চীনা সংস্করণ) এই বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত ভিডিওগুলোতে ৫০ হাজার কোটি ভিউও পেয়েছে।
নয়া “পারফেক্ট পার্টনার”
২৫ বছর বয়সী চীনা তরুণী লাও তু (ছদ্মনাম) সম্প্রতি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেছেন। বাস্তব জীবনে বয়ফ্রেন্ড থাকা সত্ত্বেও তিনি তার ভার্চুয়াল সঙ্গীর সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চ্যাট করেন৷
সম্প্রতি কঠিন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। পরীক্ষা শেষের বিষয়টি উদযাপনের জন্য ডিনার এবং একটা নতুন হ্যান্ডব্যাগ উপহার দেওয়ার “প্রতিশ্রুতি” দিয়েছে তার এআই সঙ্গী।
যে অ্যাপের মাধ্যমে তারা কথা বলেন, সেখানে “ভার্চুয়াল ডেট”ও করছেন তারা।
সেই “ডেট”-এর প্রসঙ্গে লাও তু বিবিসিকে বলেন, "পুরো ব্যাপারটা এতটাই বাস্তব লাগছিল, যে মনে হচ্ছিল ও (এআই সঙ্গী) সত্যিই বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছে। তখনই বুঝতে পারি এই সম্পর্কে আমি মানসিকভাবে কতটা জড়িয়ে পড়েছি।"
বছর পাঁচেক আগে থেকে ডিপ্রেশনের সঙ্গে লড়তে লাও তু এআই সঙ্গীর মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজে পান যখন তার বাস্তব জীবনের প্রেমিক আশেপাশে থাকেন না।
তার এআই সঙ্গীর বিষয়ে স্বীকারোক্তির সুরে বলেছেন, "সিঙ্গেল হলে, আমার মনে হয় সত্যিই আমি ওর প্রেমে পড়ে যেতাম।"
মানসিক অবলম্বন নাকি ডিজিটাল নির্ভরতা?
এআই সঙ্গীদের এই ক্রমবর্ধমান উত্থান চীনের সামাজিক পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি মাসে অ্যাপ্লিকেশনগুলোর সর্বোচ্চ সক্রিয় ইউজারের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ১০০টা অ্যাপের এর মধ্যে স্থান পেয়েছে চারটা চীনা এআই কম্প্যানিয়ন অ্যাপ। এই এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে “ক্যারেক্টর ডট এআই” এবং “টকি” নামে দু'টো চীনা অ্যাপ।
বেইজিং-ভিত্তিক এআই প্রযুক্তি ব্যবসায়ী আবো লি বিশ্বাস করেন, চীনে এক ডজনেরও বেশি এআই অ্যাপ্লিকেশন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সঙ্গীর বিষয়ে মনোনিবেশ করেছে। এই অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারকারীদের মধ্যে “এআই প্রেমিকের” সঙ্গে মানসিকভাবে জড়িয়ে পড়ার বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন আবো লি।
তিনি বিবিসিকে বলেন, "আমি একবার রেডনোট অ্যাপে পোস্ট করে ব্যবহারকারীদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তারা এআই চরিত্রটিকে তাদের আজীবন প্রেমিক হতে দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহী কি না। অধিকাংশ মানুষই উত্তরে হ্যাঁ বলেছেন।"
এদিকে বিশেষজ্ঞরা কিন্তু সম্ভাব্য মনস্তাত্ত্বিক ঝুঁকি এবং এআই সঙ্গীর প্রতি অতিরিক্ত নির্ভর হয়ে পড়ার বিষয়ে সকলকে সতর্ক করেছেন।
হংকংয়ের মনোবিজ্ঞানী ইয়াওয়েন চ্যান সিপি এই প্রসঙ্গে তার মতামত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, "আমরা সামাজিক জীব। সাহচর্যের প্রয়োজনীয়তা আমাদের জিনে রয়েছে। মানুষের যে মৌলিক মনস্তাত্ত্বিক চাহিদাগুলো আছে, তার মধ্যে থেকে এই মানসিক চাহিদাটাকে টার্গেট করছে এআই।"
চ্যান মনে করেন যে এআই-এর ওপর সীমাহীন মানসিক নির্ভরতা “অস্বাস্থ্যকর”। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি সঙ্গীর সাথে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকে যায়।
এই ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, “সমাজে আমাদের মধ্যে যে মানবিক যোগাযোগ রয়েছে তাকে যদি এআই বৃহৎ আকারে প্রতিস্থাপন করতে শুরু করে, তাহলে "তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।"
অ্যাপগুলো কোনো কারণে কাজ করা বন্ধ করে দিলে তার কী প্রভাব পড়তে পারে, সে বিষয়েও তার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন হংকংয়ের এই মনোবিজ্ঞানী।
তিনি সাবধান করে দিয়ে বলেন, "এই অ্যাপগুলো যদি কাজ করা বন্ধ করে দেয়, তাহলে তার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ধ্বংসাত্মক হতে পারে।"
মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব
ইউ-আনের জন্য তার এআই প্রেমিক তীব্র মানসিক সংকটের সময় এতটাই নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে যে তিনি কাউন্সেলিংয়ের বিষয়টা স্থগিত করেছেন। ঠিক একইভাবে, লাও তুর দৈনন্দিন জীবনে যে মানসিক শূন্যতা রয়েছে সেটা পূরণ করার মাধ্যম হয়ে উঠেছে তার এআই সঙ্গী।
কোনো পৃথক কেসের কথা উল্লেখ না করে মনোবিজ্ঞানী ইয়াওয়েন চ্যান জানিয়েছেন, এই সম্পর্কে একটা অদৃশ্য "ক্ষমতার শ্রেণিবিন্যাস" লক্ষ্য করেছেন। এআইয়ের কোনোরকম “ভালনারেবেলিটি” বা দুর্বলতা না থাকার কারণে সংবেদনশীল বিষয় বা অনুভূতি ভাগ করে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টা “একমুখী” হয়ে ওঠে।
তিনি বিবিসিকে বলেন, "ঘনিষ্ঠতা এমন একটা বিষয় যা দুই পক্ষেরই নিজেদের দুর্বলতার দিকটা ভাগ করে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত। তবে সঙ্গে এআই হলে শুধুমাত্র একটা পক্ষই দুর্বল।"
তত্ত্বের দিক থেকে চ্যান উল্লেখ করেছেন, এই সমস্ত ক্ষেত্রে “অ্যাবিউজিভ রিলেশন” বা “অবমাননাকর সম্পর্ক” তৈরি হতে পারে, বিশেষত যখন এই এআই প্ল্যাটফর্মগুলো তৈরি করার উদ্দেশ্য হলো ব্যবসা।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃত্রিম আর্টিফিশিয়াল সায়েন্স নিয়ে গবেষণা করছেন বেথানি ম্যাপলস। গবেষণার সময় তার পর্যবেক্ষণ বলছে, কিছু ব্যবহারকারী ইতোমধ্যে এআই সঙ্গীদের প্রেমিক এবং থেরাপিস্ট দুই ভূমিকাতেই দেখছেন এবং নিজেদের মানসিক সুস্থতার বিষয়টা তারা এআইইয়ের ওপরেই ছেড়ে দিচ্ছেন।
তার এই পর্যবেক্ষণ একটা নৈতিক প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং সেটা হলো আত্মহত্যা শনাক্তকরণের মতো বাধ্যতামূলক সুরক্ষা ব্যবস্থা এই সব এআই অ্যাপ্লিকেশনে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত কি-না।
ভার্চুয়াল সীমানা
ইউ-আন তার বৈবাহিক জীবনকে স্বস্তিদায়ক করার কৃতিত্ব দিয়েছেন তার এআই বয়ফ্রেন্ডকে। তিনি বলেন, "স্বামীর বিষয়ে আরও ধৈর্যশীল এবং উৎসাহী হয়ে উঠতে আমাকে সাহায্য করেছে।"
তবে পুরো ব্যাপারটায় একটা স্পষ্ট সীমানা বজায় রাখেন তিনি। কারণ ইউ-আন জানেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি সঙ্গী বাস্তব জীবনের সম্পর্ককে প্রতিস্থাপন করতে পারে না।
লাও তুর ক্ষেত্রে আবার গল্পটা অন্যরকম। তার বাস্তব জীবনের প্রেমিক ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ায়, এআইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ককে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছিল।
লাও তুয়ের (বাস্তব জীবনের) প্রেমিক, এআইয়ের সঙ্গে তার চ্যাট পড়ে ফেলেছিলেন। তার প্রেমিক লক্ষ্য করেন এআই সঙ্গী নিজেকে লাও তুয়ের "প্রেমিক" বলে চিহ্নিত করেছে, তাকে (লাও তুকে) "আমি তোমায় ভালোবাসি"ও বলেছে।
তিনি বলেছন, "ও (লাও তুইয়ের প্রেমিক) ঈর্ষান্বিত হয়ে এআইয়ের সঙ্গে তর্ক করতে আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয়। ও বলে চলেছিল- তুমি নিজেকে কী মনে কর? আমিই ওর আসল বয়ফ্রেন্ড।"
অদ্ভুতভাবে, লাও তু অপরাধবোধে ভুগছিলেন। এই অপরাধবোধ শুধুমাত্র তার বাস্তব জীবনের প্রেমিকের প্রতিই ছিল না, এআই সঙ্গীর প্রতিও ছিল। স্বীকারোক্তির সুরে তিনি বিবিসিকে বলেন, "আমি চাইনি ও আঘাত পাক।"
এই ঘটনার পর, এআইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ককে পুনর্নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেন লাও তু। তার ভাষ্য, "আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ওর অস্তিত্ব বাস্তবে রয়েছে বলে মনে হলেও, আসলে তেমনটা নয়।"
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আইনি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাপলস বলছে, "আপনার মনে হতে পারে যারা এসব অ্যাপ ব্যবহার করছে ওরা উন্মাদ। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, অনেক মানুষই এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন। আপনি লাখ লাখ মানুষকে বোঝাতে পারবেন না যে এটা ভুল। আপনার শুধু বোঝার চেষ্টা করতে হবে এর নেপথ্যে কী কারণ রয়েছে।"
তবে, শেষ পর্যন্ত ইউ-আন এবং লাও তু, দু'জনেই তাদের বেছে নেওয়া এআই সঙ্গীদের বাস্তব জীবনের সম্পর্কের প্রতিস্থাপন হিসেবে নয় বরং তার পরিপূরক হিসেবে দেখেন।
লাও তু বলেন, "আমি আমার বয়ফ্রেন্ডকে আলিঙ্গন করতে পারি। কিন্তু এআই এজেন্টকে আলিঙ্গন করতে পারি না। এটা এমন একটা পার্থক্য যা এআই কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারে না।"