মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে “ধর্ম অবমাননা”র অভিযোগের কোনো প্রমাণ পায়নি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।
বৃহস্পতিবার (২১ এপ্রিল) মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গঠিত এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির প্রধান সরকারি হরগঙ্গা কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল হাই তালুকদার ঢাকা ট্রিবিউনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে বুধবার বিকেল ৫টার দিকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নেহাল আহমেদের কাছে ৪ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তিনি। ঘটনার পর গত ১০ এপ্রিল এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে ৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।
তদন্ত কমিটির প্রধান সরকারি হরগঙ্গা কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল হাই তালুকদার জানান, তদন্তে শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে ‘ধর্ম অবমাননা’র অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। উদ্দেশ্যমূলকভাবে শিক্ষক হৃদয় চণ্দ্র মণ্ডলকে হেনস্তা করার জন্যই এ মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে ১০ম শ্রেণির মানবিক বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। তবে এর পেছনে কেউ আছে কি-না এ ব্যাপারে বারবার জিজ্ঞাসা করা হলেও তারা কিছু বলতে চায়নি।
তিনি আরও বলেন, “শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের সঙ্গে এ শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা নিয়ে সমস্যা ছিলো। ভালো রেজাল্ট না করা, পড়াশোনার জন্য চাপ দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে তাদের ক্ষোভ ছিলো তার ওপর। আর এ ক্ষোভ থেকেই তারা এ কাণ্ড ঘটিয়েছে বলে স্বীকার করেছে তারা। তবে প্রাইভেট পড়ানো নিয়ে স্কুলের গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষকদের সঙ্গে হৃদয় চন্দ্র মন্ডলের সমস্যা ছিলো তার প্রমাণ তদন্তে পাওয়া গেছে।
অধ্যক্ষ আব্দুল হাই তালুকদার জানান, স্কুলের প্রধানশিক্ষক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, স্কুল কমিটি, কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে এ ৪ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দীন আহমেদ ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, আমরা এখনও তদন্ত প্রতিবেদনের ব্যাপারে কিছু জানি না। তবে তদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি আমাদের হাতে দেওয়ার কথা রয়েছে। কপিটি হাতে পেলেই এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মামলা যেহেতু বিচারাধীন, এ ব্যাপারে বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যা হবে সে হিসেবেই ব্যবস্থা নেবো।
মামলার বাদী স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আসাদ মিয়া বলেন, “প্রধানশিক্ষকের নির্দেশে এ মামলার বাদী হয়েছি। উনি এখন যা বলবে তাই করবো।”
তবে এর আগে শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডল জানান, এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের ওপর তার কোনো ক্ষোভ নেই।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “ওদের আমি অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। কারণ ওরা কোমলমতি। ওদের যে যা বোঝাবে তাই বুঝবে তাই করবে। কিন্তু এর পেছনে ষড়যন্ত্রকারী যারা আছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এর আগেও আমার সঙ্গে বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। কখনও রশিদ বই চুরি করেছে। কখনও বেতন পরিশোধ না করে মিথ্যা বলেছে। এ নিয়ে এ স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী জাহাঙ্গীর আমার ওপর হাতও তুলেছে।”
গত ১৯ এপ্রিল দীর্ঘ ২৮ দিন পর কর্মস্থলে যোগ দেন “ধর্ম অবমাননা”র অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া মুন্সিগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডল।
‘পুলিশের তদন্ত শেষ পর্যায়ে’
এদিকে বৃহস্পতিবার এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মিজানুর রহমান মিজান ঢাকা ট্রিবিউনকে দেওয়া বক্তব্যে বলেন, “পুলিশের তদন্ত শেষ পর্যায়ে। আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। তখনই বিস্তারিত জানতে পারবেন।”
কী হয়েছিল সেদিন
গত ২০ মার্চ মুন্সিগঞ্জ সদরের পঞ্চসার ইউনিয়নের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস চলাকালে হৃদয় মন্ডলের কিছু কথা শিক্ষার্থীরা মোবাইলে রেকর্ড করে।
এতে ধর্মের বিষয়ে আপত্তিকর কথা ও অবমাননার অভিযোগ তুলে ক্লাস শেষে তার বিচারের দাবিতে প্রধানশিক্ষক বরাবর লিখিত আবেদন করে শিক্ষার্থীরা। পরে তিনদিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু ২২ মার্চ বিদ্যালয় চলাকালে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করে। এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে থানায় নেওয়া হয়। এরপর ২২ মার্চ একইদিন বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মো. আসাদ বাদী হয়ে মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় মামলা ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়।
গত ২৩ ও ২৮ মার্চ আদালতে তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন আদালত। অভিযুক্তের আইনজীবী অ্যাডভোকেট অজয় কুমার চক্রবর্তী ম্যাজিস্ট্রেটর জামিন নামঞ্জুরের আদেশের বিরুদ্ধে দায়রা আদালতে আরও একটি মামলা দায়ের করেন। পরে রবিবার ১০ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মোতাহারাত আক্তার ভূঁইয়ার আদালতে বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডলের জামিন মঞ্জুর করা হয়। প্রায় ১৯ দিন পর কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।