জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমেই হুমকিতে পড়ছে চিংড়ি চাষ। নদ-নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে। জোয়ারের স্বাভাবিক গতিও কমছে। পানিতে লবণের মাত্রা কমছে, সেইসঙ্গে পানির উষ্ণতা বাড়ছে। ফলে পানিতে তাপমাত্রার তারতম্য ঘটে চিংড়ির মৃত্যু হার ও রোগবালাই বাড়ছে। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন চিংড়ি চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন ও মিথেনসহ নানা ধরনের ক্ষতিকারক গ্যাস বৃদ্ধি পায়। এই গ্যাসগুলো বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে চলেছে। ফলস্বরূপ মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে, যার কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সমুদ্রের নিকটবর্তী নিম্ন অঞ্চলগুলো প্লাবিত হচ্ছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ায় জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নদ-নদীর পানিপ্রবাহ শুকনো মৌসুমে স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে না। ফলে নদীর পানির বিপুল চাপের কারণে সমুদ্রের লোনাপানি যতটুকু এলাকাজুড়ে আটকে থাকার কথা ততটুকু থাকে না, পানির প্রবাহ কম থাকার কারণে সমুদ্রের লোনাপানি স্থলভাগের কাছাকাছি চলে আসে। ফলে লবণাক্ততা বেড়ে যায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল এলাকায়।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, দেশের দাকোপসহ দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্র ভূ-ভাগের অনেক ভেতর পর্যন্ত লোনাপানি ইতোমধ্যে ঢুকে পড়েছে। কম বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার সমস্যা দিনে দিনে আরও প্রকট হয়ে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের প্রধান ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোস্তফা সারোয়ার বলেন, “তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে চিংড়ির রেণুর মৃত্যুহার বেড়েছে। প্রাকৃতিক খাদ্যচক্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে কৃত্রিম খাবার দেওয়া লাগছে। এতে অল্প কিছু রেণু টিকছে। বাকিগুলো মারা যাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে রেণুর স্বাভাবিক বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি হয় না। রেণুর তাপ সহ্য ক্ষমতা আর বয়স্ক চিংড়ির তাপ সহ্য ক্ষমতার পার্থক্য আছে। সাধারণত ঘের তৈরির পর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে রেণু ছাড়া হয়। মার্চে এসে মারাত্মক গরম পড়ে। তখন তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি হলে তো পানির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি থাকে না। সেটি ২৭ ডিগ্রিতে উঠে যায়। যা রেণুর জন্য সহনীয় পর্যায়ে থাকে না। গরম পানিতে রেণু টিকতে পারছে কম। আর ঘেরের গভীরতা কম, ঘেরে পানির উচ্চতাও বাড়ে না। বায়ুর তাপে পানি গরম হয়ে ওঠে। যা চিংড়ির স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাপমাত্রা বাড়লে যেকোনো ধরনের ভাইরাসের দাপট বেড়ে যায়। ভাইরাসের জীবন চক্র সক্রিয় অবস্থানে রাখতে প্রয়োজন তাপমাত্রা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, এতে গরমের কারণে চিংড়ির পোনার টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় যদি ভাইরাস পানির সংস্পর্শে চলে আসে সেটা ভাইরাসের জন্য সহনীয় অবস্থান। ফলে বড় চিংড়িতে ভাইরাস আক্রান্তে সময় লাগলেও ছোট চিংড়ি আক্রান্ত হতে সময় লাগে না। এজন্য রেণু দ্রুত মারা যায়। চিংড়িতে মড়ক দেখা দেয়।”
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সহ-সভাপতি হুমায়ুন কবীর বলেন, “৬০-এর দশকে দেশে চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে এটি শিল্প হয়ে উঠেছিল। গুণগত মানের কারণে ৮০-এর দশক থেকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত বাগদা চিংড়ি বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়। কিন্তু এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চিংড়ি উৎপাদন কমেছে। সেইসঙ্গে চাহিদা এবং দামও কমেছে।”
তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাল-বিল, নদী-নালা শুকিয়ে ভরাট হয়ে গেছে। পানির উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে চিংড়ির মৃত্যুহার বেড়েছে। প্রাকৃতিক চিংড়ির পোনাও মিলছে না। অল্প কিছু পাওয়া গেলেও ঘেরে ছাড়ার পর পানির তাপমাত্রা সহনীয় না থাকায় সেগুলো টিকছে না। ফুটন্ত পানিতে চিংড়ি কতক্ষণ টিকতে পারে? তাপমাত্রা সহনীয় থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা এখন নেই। ভালো পরিবেশ দরকার ছিল, তাও নেই। চিংড়ির পোনা খুবই স্পর্শকাতর। তার জন্য পানি, খাবার, পরিবেশ ও তাপমাত্রা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাপমাত্রা সহনীয় না থাকায় চিংড়ি টিকছে না, কীভাবে চাষিরা লাভবান হবেন। রোগবালাইয়ের শেষ নেই। এজন্য মৃত্যুহার বেড়ে গেছে।”
খুলনা বিভাগীয় পোনা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও পাইকগাছা উপজেলার পুরস্কারপ্রাপ্ত ঘের ব্যবসায়ী গোলাম কিবরিয়া রিপন বলেন, “জানুয়ারি মাস থেকে এই অঞ্চলের নদ-নদীতে লবণাক্ত পানি চলে আসতো। গত বছর লবণাক্ত পানি আসতে দেরি হয়। ফলে এক মাস পিছিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে লবণাক্ত পানি আসে। এ বছরও তাই হয়েছে। বৃষ্টির সময় বৃষ্টি নেই। পানিতে লবণের পরিমাণ অসময়ে বেশি হচ্ছে, আবার প্রয়োজনের সময় কমে যাচ্ছে। সাধারণত মে-জুন মাসে পানিতে লবণের মাত্রা ১৬-১৮ পিপিটি থাকে। কিন্তু মাঝেমধ্যে ৮-১০ পিপিটিতে নেমে আসে। বৃষ্টির স্বাভাবিক গতি ঠিক না থাকায় লবণের মাত্রায় হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। ফলে চিংড়ি চাষ ব্যাহত হচ্ছে। আগে সনাতন পদ্ধতির ঘেরে হ্যাচারির পোনা ছাড়ার পর ৬০-৭০% টিকতো। এখন ১৫-২০% পোনাও বাঁচে না। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়া ও লবণের মাত্রায় হ্রাস-বৃদ্ধির কারণে চিংড়ি চাষে লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষিদের। এ অবস্থায় কেউ কেউ চিংড়ি ছেড়ে সাদা মাছ চাষ করছেন।”
তিনি বলেন, “নদ-নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। জোয়ারের পানি ঘেরে ঢোকানোর ফলে বিভিন্ন প্রজাতির পোনা আসতো। কিন্তু নাব্যতা সংকটের কারণে এখন ওসব পোনা আসে না। পানির এ অবস্থার কারণে মাটির তারতম্যে পরিবর্তন হয়েছে হয়তো। যে কারণে চিংড়ি চাষে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ৩০-৪০ বছর ধরে আমরা যারা চিংড়ি চাষ করছি, তারাও লোকসানে পড়েছি। নদ-নদীর নাব্যতা ফেরাতে ড্রেজিং করা জরুরি।”
এদিকে, কিছুটা হলেও আশা দেখছেন চাষিরা। “কমিউনিটি-বেইজড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ” প্রকল্পের আওতায় গত মে মাসে ডুমুরিয়া উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে মাছ চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনগ্রসর নারীদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রশিক্ষণে উপজেলার রুদাঘরা ইউনিয়নের শোলগাতিয়া জেলেপাড়ার ১২ নারী অংশ নেন। প্রশিক্ষণের আলোকে মৎস্য অফিসের তত্ত্বাবধানে ওই ১২ নারীর সঙ্গে এলাকার আরও ১৩ পুরুষকে নিয়ে “রুদাঘরা বাগদা চাষি সিবিও” সমিতি গড়ে তোলা হয়। প্রত্যেক সদস্য মাসে ২০০ টাকা করে চাঁদা ও প্রশিক্ষণ থেকে পাওয়া সাড়ে ১২ হাজার টাকা দিয়ে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলেন। এরপর ৪৫ হাজার টাকা জমা করেন। জুন মাসে মাছ চাষের জন্য বছরে ৭০ হাজার টাকা হারে চুক্তিতে হরি নদীর চরে এক একর জমি লিজ নেন।
তখন মৎস্য অফিস থেকে ওই সমিতিকে মাছ চাষের জন্য দুই লাখ সাত হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়। ততদিনে লিজ নেওয়া জমি মাছ চাষের জন্য তৈরি করে গত ২০ জুন সেখানে সাড়ে ১৫ হাজার বাগদা ও ২০ হাজার ৮০০ গলদা চিংড়ির রেণুসহ বিভিন্ন মাছ ছাড়া হয়। সম্প্রতি ওই খামার থেকে ৩০ হাজার টাকার বাগদা বিক্রি করেছেন উদ্যোক্তারা। নারীদের তত্ত্বাবধানে মাছ চাষের প্রকল্পটি এলাকাবাসীর মাঝে দারুণ সাড়া ফেলেছে।
মাছ চাষি স্বপ্না রানী বলেন, “শোলগাতিয়া এলাকায় হাজারের বেশি চিংড়ি ঘের আছে। কিন্তু মৎস্য অফিসের অনুপ্রেরণায় এই প্রথম আমরা এলাকার নারীরা একটা ঘের করেছি। ইতোমধ্যে মাছ বিক্রি করেছি। আমরা সফল।”
একই প্রকল্পের মাছ চাষি সুমতি বিশ্বাস বলেন, “মাছ চাষের জন্য ঘর থেকে একটু বের হতে পেরেছি। অনেক আশা নিয়ে মাছ চাষ শিখেছি। সফল হতে পেরে আনন্দিত আমরা।”
খুলনা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, ২০১১-১২ অর্থবছরে খুলনা থেকে ৪২ হাজার ৪৮৯ দশমিক ১০৩ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে। এ থেকে দুই হাজার ৫৩৩ কোটি চার লাখ টাকা আয় হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৩ হাজার ২৭১ দশমিক ১৮২ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে। এ থেকে দুই হাজার ৯৬২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা আয় হয়। এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩০ হাজার ২১৭ দশমিক সাত মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি থেকে দুই হাজার ৫৮৮ কোটি ২৪ লাখ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৯ হাজার ২০০ দশমিক ৭৮৮ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি থেকে দুই হাজার ৪৮৮ কোটি ৬৬ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৯ হাজার ছয় দশমিক ৮২১ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি থেকে দুই হাজার ২৯০ কোটি ২০ লাখ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৯ হাজার ৫৪০ দশমিক ৯৬৭ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি থেকে দুই হাজার ৩৫৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা আয় হয়।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব কুমার বলেন, “পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে চাষিদের ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ বন্ধে নজরদারি বাড়ানোসহ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি চাষি থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানির মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছি আমরা।”
কয়রা উন্নয়ন সমন্বয় সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় এলাকায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকার ও উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপকূলীয় এলাকায় ক্ষতির দিক বিবেচনায় এনে টেকসই প্রকল্প হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট রয়েছেন। তবে ব্যাপকভাবে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হলে এই জনপদের মানুষ দুর্যোগের ক্ষতি থেকে রেহাই পাবে।”
প্রসঙ্গত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গত তিন দশকে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদী ভাঙনে উপকূলীয় জনপদ লন্ডভন্ড হয়ে যায়। গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের তলদেশ উঁচু হচ্ছে, অন্যদিকে নদ-নদীর নাব্যতা হারিয়ে পরিবর্তন এসেছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মানুষজন। ১৯৮৮ সালের ২৯ নভেম্বর সুন্দরবন উপকূলে ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরের এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে খুলনা-সাতক্ষীরা উপকূলে আইলার তাণ্ডবে উপকূলীয় দৃশ্যপট পাল্টে যায়। এছাড়া আম্ফান, নার্গিস এবং ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।