খুলনায় প্রতি বছরই কমছে চিংড়ির উৎপাদন ও রপ্তানি। সরকারিভাবে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ বছরের প্রতি বছরেই দেশে চিংড়ি রপ্তানি অন্তত ৩,০০০ টন করে হ্রাস পেয়েছে।
ফিস ইন্সপেকশন অ্যান্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল (এফআইকিউসি) খুলনা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে খুলনা অঞ্চল থেকে ২৪,১০০ টন বাগদা ও গলদা রপ্তানি হয়েছিল। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৯,৯০০ টনে।
যে কারণে কমেছে উৎপাদন
লোনা পানির উৎস কমে যাওয়া, ভাইরাসের আক্রমণ, আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বনে কৃষকদের অনাগ্রহ ও রোগমুক্ত পোনা না পাওয়াসহ নানা কারণে খুলনায় চিংড়ির উৎপাদন কমে গেছে।
খুলনার দৌলতপুর এলাকার এক চিংড়ি চাষি জানান, চিংড়ি উৎপাদনের জন্য জলাশয়ে পর্যাপ্ত পানি নেই। এর পাশাপাশি সবসময়ই ভাইরাস আক্রমণের প্রাদুর্ভাব থাকে বলেও জানান তিনি।
তাছাড়া খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণেও চিংড়ি চাষীরা লোকসানের মুখে পড়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্যের সমস্যার পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতিও এর পেছনে ভূমিকা রাখছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কৃষক জানান, তার চিংড়ি ঘেরের পাশে একটি প্রকল্প নির্মাণ করেছে একটি শক্তিশালী পক্ষ। তারা প্রয়োজনীয় পানি প্রবাহিত হতে দিচ্ছে না, ফলে অপর্যাপ্ত পানির কারণে তার খামার বন্ধ করে দিতে হচ্ছে।
লোকসান নিয়ে এখন আর কোনো চাষি চিংড়ির ব্যবসা করতে চায় না বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে খুলনার মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পালের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সাম্প্রতিক তথ্য
দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার অপার সম্ভাবনার এ শিল্প ক্রমেই গতি হারাচ্ছে।
গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান দেখায়, দেশে চিংড়ির উৎপাদন ক্রমাগত কমছে। যার প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক রপ্তানিতে।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৯,৭০৬ টন। পরের অর্থবছরে (২০১৭-১৮) তা কমে হয় ৩৬,১৬৮ টন।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ সালে রপ্তানি কমে ৩৩,৩০৬ টনে দাঁড়িয়েছে ও ২০১৯-২০ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩০,০৩৬ টনে।
২০২১-২২ অর্থবছরে চিংড়ি উৎপাদন কমে ৩০,৫৭১ টন হয়েছে।
উৎপাদন কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সোবি ফিশ প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক মো. মাহবুবুল হক বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উৎপাদন অনেক কমে গেছে। এই শীতকাল খুব দীর্ঘ ছিল; এখনো তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় পর্যাপ্ত পানি আসেনি, ফলে এবার উৎপাদন খুবই কম।”
স্থানীয় বাজারে দাম বেড়েছে
চিংড়ি উৎপাদন কমে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারেও এর প্রভাব পড়ছে।
ঢাকার কারওয়ান বাজার মাছের বাজারে আকার ও শ্রেণিভেদে চিংড়ির দাম কেজি প্রতি ১,০০০ থেকে ১,২০০ টাকা। তবে খুচরা দাম আরও বেশি।
কারওয়ান বাজারে চিংড়ি কিনতে আসা এক ক্রেতা বলেন, “আমার স্বল্প আয়ের পরিবারে চিংড়ি কেনা একটি বিলাসিতা। আমি আমার সন্তান ও বাবা-মাসহ আমার ছয়জনের পরিবারের জন্য এক কেজি কিনেছি। এতে আমার খরচ ১,২০০ টাকা। দাম কম হলে আরেকটু বেশি কিনতাম।”
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. রকনুজ্জামান বলেন, “কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের রপ্তানিকৃত পণ্য ফেরত যাচ্ছে। তারা চিংড়ির মধ্যে জেলি ও ক্ষুদ্র লোহার টুকরা ব্যবহার করে, যা স্ক্যানিংয়ে ধরা পড়ে। ফলে আমাদের চুক্তি বাতিল হয়ে যায়।”
তাছাড়া দেশে উৎপাদিত চিংড়ির পোনার দাম বেশি থাকায় চাষিরা বাইরে থেকে পোনা সংগ্রহ করছেন।
“আমাদের দেশে কোয়ারেন্টাইনে উৎপাদিত চিংড়ি পোনার দাম ৪০-৪৫ পয়সা, যেখানে ভারত থেকে অবৈধভাবে আনার দাম ১০-১৫ পয়সা। তবে তারা যে রোগ বহন করে তা একটি এলাকার চিংড়ির খামার ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট।”
তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও বিধি-বিধানের মাধ্যমে চিংড়ি চাষের সেই উজ্জ্বল দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
“যেহেতু চিংড়ি চাষের খরচের ৭০-৭৫% খাবারে যায়, তাই সরকারের উচিত যতটা সম্ভব খরচ কমানো ও ভালো মানের পোনা উৎপাদন করা।”
তৃণমূলে কৃষকরা প্রণোদনা না পেলে চিংড়ি চাষের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নেই বলেও জানান তিনি।