এবার কলকাতা ভ্রমণের সময়ের কথা। গুগল ম্যাপে হঠাৎ ‘‘বরিশালপাড়া'' দেখে অবাক হই। চমৎকৃত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি এলাকাটি ঘুরে আসব। যাওয়ার পথে গেলাম গড়িয়াহাট হয়ে বাসে। এরপর জোকা হয়ে পৈলান পৌঁছাই। পৈলান ক্রসিং থেকে নেপালগঞ্জ রোড ধরে প্রায় দেড় কিলোমিটার পরেই বরিশালপাড়া।
নগরের খুব কাছে সব ধরনের সুবিধা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই ছোট পাড়াটি। নাগরিক সুবিধার পাশাপাশি এখানকার বাড়তি পাওয়া গ্রামীণ পরিবেশ। প্রায় প্রতিটি বড়িতেই একটি পুকুর, বড় উঠান, সঙ্গে আছে গাছগাছালিতে ভরা প্রাঙ্গণ। সবুজে ঘেরা বাড়িগুলো মনে করিয়ে দেয় বৃহত্তর বরিশাল জনপদের কথা।
পাড়া ঘুরে জানতে পারি, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি থেকে আসা শ্রী সুকলাল মণ্ডল ১৯৮০ সালে এ এলাকায় জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করেন। তিনিই প্রথম এখানে সপরিবারে আসেন। তখন এলাকাটিতে মাত্র তিন-চারটি বাড়ি ছিল। বেশিরভাগ জায়গা ছিল ধানচাষের উপযোগী নিচু ফসলি জমি।

শহর থেকে দূরত্ব ও নিচু হওয়ায় তখন জমির দাম ছিল কম। সে কারণে একে একে পরিচিতজনদের মাধ্যমে বরিশাল প্রত্যাগত পরিবারগুলো এখানে ঠাঁই খুজে নেয়। গড়ে তোলে ফেলে আসা স্বর্গসম স্বপ্নের বরিশালের ক্ষুদ্রতর মডেল “বরিশালপাড়া”।
পরিবারগুলো ১২-১৪ কাঠা, কেউ এক বিঘা বা সম্ভব হলে তারও বেশি পরিমাণ জমি কেনে বসতভিটা গড়ার জন্য।
বরিশালের মানুষ, আর বাড়িতে পুকুর থাকবে না তাই কি হয়? প্রথমে পুকুর কেটে ঘরের ভিটি-উঠান ও গাছপালার জন্য জমি প্রস্তুত করেন । তারপর উঁচু ভিটিতে তৈরি করেন বাড়ি। মজার বিষয় হলো
প্রতিটি বাড়ি যেন তাদের বরিশালের গ্রামে ফেলে আসা বাড়ির প্রতিরূপ।

বর্তমানে ৮০-৯০টি পরিবারের বসবাস বরিশালপাড়ায়। যার মধ্যে ৬৫টি বাড়িতেই থাকেন বরিশাল প্রত্যাগত বা তাদের বংশধররা। পরিবারগুলো মূলত ১৯৬৪-৬৫ ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করে।
কথা হয় বরিশালপাড়ার বাসিন্দা শ্রী আশুতোষ সিকদারের সঙ্গে। তার আদি বাড়ি পিরোজপুরের ব্রাহ্মণকাঠি গ্রামে। '৮০-র দশকের শুরুতে তিনি ভাড়া বাসা ছেড়ে ১ বিঘা জমি কেনেন এখানে।
বরিশালের মতোই বাড়িতে পুকুর, উঠান, বাগান গড়ে তোলেন।
স্বচ্ছল আশুতোষ পেশায় কারুশিল্পী। তার নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় সাধারণ পাট হয়ে ওঠে ঘর সাজানোর শৈল্পিক পণ্য। এসব জিনিসপত্র তিনি ভারতের বড় বড় শহরে বিপণন করেন।
বরিশালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হারিয়ে গেলেন যেন কোথায়। জানালেন, বহু বছর আগে ছেড়ে আসা স্বজনদের সঙ্গে আজও কথা হয় মোবাইল ফোনে।
এ পাড়ার সবাই গড়ে তুলেছেন ‘‘নবারুণ পল্লী ক্লাব''। এই ক্লাবই সারা বছরের পূজো-পার্বণ আয়োজন করে সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। উৎসবের আমেজ-উচ্ছ্বাসে ডুবে তারা ভুলে থাকতে চান মাতৃভূমি ত্যাগের বেদনা।