Tuesday, March 18, 2025

সেকশন

English
Dhaka Tribune

জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খাওয়া নিয়ে যত প্রশ্ন ও ভুল ধারণা

মনে অনেক প্রশ্ন থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ পান না

আপডেট : ০৯ মে ২০২৪, ০৫:২৫ পিএম

বিশ্বজুড়ে জন্মনিয়ন্ত্রণের একটি কার্যকর পন্থা হিসেবে মুখে খাওয়ার জন্মনিরোধক বা ওরাল কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল বেশ প্রচলিত।

পুরুষদের জন্য এখনও কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বাজারে আসেনি। এটি এখন পর্যন্ত কেবর নারীরাই খেয়ে থাকেন।

জন্মনিয়ন্ত্রণ ট্যাবলেট বা পিল মূলত এক ধরনের ওষুধ যাতে হরমোন থাকে, যে হরমোন নারীর ডিম্বাশয় থেকে ডিম নিঃসরণে বাধা দিয়ে গর্ভধারণ প্রতিরোধে সহায়তা করে।

বেশিরভাগ মুখে খাওয়ার গর্ভনিরোধকে এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টিন হরমোন থাকে। এর প্রধান কাজ ওভুলেশন বা ডিম নিঃসরণে বাধা দেয়া, এবং এস্ট্রোজেন মাসিকের রক্তপাত নিয়ন্ত্রণ করা।

চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো নিয়মিত জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খেলে ৯৯% ক্ষেত্রেই গর্ভধারণ প্রতিরোধ করা যায় বলে জানা গেছে।

বাজারে কয়েক ধরনের পিল পাওয়া যায়। যেমন- কম্বাইন্ড ওরাল পিল, প্রোজেস্টেরন অনলি পিল বা মিনিপিল এবং ইমার্জেন্সি পিল। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত ট্যাবলেট বা পিল কম্বাইন্ড পিল, যা এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের মিশ্রণে তৈরি।

কম্বাইন্ড পিল সাধারণত ২৮টি ট্যাবলেটের একটি পাতায় পাওয়া যায়। যার মধ্যে ২১টি সক্রিয় পিল থাকে, আর সাতটি নিষ্ক্রিয় আয়রন পিল থাকে।

সাধারণ ক্ষেত্রে মাসিকের প্রথম দিন থেকে পিল খাওয়া শুরু করতে হয় এবং টানা ২১ দিন খেতে হয়।

প্রথম দিন খেতে ভুলে গেলে পঞ্চম দিন পর্যন্ত যেকোনো দিন শুরু করা যায়। কেউ একদিন পিল খেতে ভুলে গেলে, পরদিন যখন মনে পড়বে তখনই খেয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।

তবে জন্মনিরোধক পিল খাওয়া নিয়ে সমাজে নানা ধরনের ভ্রান্তি রয়েছে। রয়েছে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে নানা সংশয় ও প্রশ্ন।

অনেকেই মনে করেন, পিল খেলে নারীরা মোটা হয়ে যায়। কারো হয়ত মাথা ব্যথা করে, কারো মুড সুইং হয়; কারো মনে প্রশ্ন এতে পিরিয়ডে সমস্যা হবে কি-না, আবার পিল দীর্ঘ সময় খাওয়া যায় কি-না তা নিয়েও সন্দিহান কেউ কেউ।

যদিও সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা প্রকাশ্যে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন না।

তবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহারকারী নারীদের এসব ধারণার আদৌ কি কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যতা রয়েছে? চলুন, জেনে নিই সেরকম কিছু প্রশ্ন আর ধারণা সম্পর্কে-

মোটা হয়ে যাওয়া

অনেক নারীই মনে করেন পিল খেলে মোটা হয়ে যায়। কিন্তু কোনো গবেষণায় এটির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

চিকিৎসকরা বলছেন, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল খেলে মেয়েরা মোটা হয়ে যায় এটি সঠিক নয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওজন বাড়ে। আর সেটা মূলত বাড়ে শরীরে জলীয় পদার্থ জমে যাওয়ার কারণে।

তবে এই জলীয় পদার্থ জমে যায় কিন্তু পিল খাওয়ার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায়। যা আবার কয়েক মাসের মধ্যে চলেও যায়।

এ বিষয়ে ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক কিশোয়ার লায়লা যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আগে পিল খেলে মোটা হতো এমন ধারণা ছিল। কিন্তু সেটা সঠিক ছিল না। আবার এখন আধুনিক যেসব লাইট পিল পাওয়া যায় সেসব খেলে মোটা হয় এটাও ঠিক না। অর্থাৎ পিলের জন্য মোটা হয় এ তথ্য সঠিক নয়।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক রেজাউল করিম কাজল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “শুরুর দিকের পিলগুলোতে যে হরমোন ব্যবহার করা হতো, তাতে ক্ষুধা বাড়ত, শরীরে কিছুটা পানিও জমাতে- তাই ওজন বাড়ত। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত পিলগুলো তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের। চতুর্থ প্রজন্মের পিলগুলোতে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে।"

তিনি আরও বলেন, “এগুলো রক্তের কোলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া মাসিক নিয়মিতকরণসহ নারীদের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার পিল ব্যবহার করা হয়।”

মুড সুইং

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব নারীরা জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খান অনেক সময়ই তাদের আচরণ পাশে থাকা মানুষেরা বুঝতে পারেন না। কখন তারা খুশি আর কখন বিষাদ গ্রাস করেছে তাদের- তা অনুমান করা কঠিন।

সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, এ নারীদের মুড সুইং হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, মস্তিষ্কের ওপরেও জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের প্রভাব রয়েছে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক কিশোয়ার লায়লা বলেন, “বর্তমানে যে জেনারেশনের (ধরনের) স্বল্পমাত্রার পিল বাজারে পাওয়া যায়, তাতে মুড সুইং এখন কম হয়। আগে পিলে হরমোনের উচ্চ মাত্রা ছিল এখন পিলের ডোজ অনেক লো (কম)। ফলে মুই সুইং খুব কম হয়।”

পিরিয়ড বা মাসিক সংক্রান্ত জটিলতা

জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল জন্ম নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও অবিবাহিত ও বিবাহিত নারীদের অনিয়মিত মাসিক, মাসিকের সঙ্গেঅতিরিক্ত রক্তস্রাব, মাসিকের সময় তলপেটে ব্যথা, মুড সুইংসহ নানা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা।

এছাড়া এনডোমেট্রিওসিস, ডিম্বাশয়ের সাধারণ ছোট খাটো সিস্ট, বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসায় নির্দিষ্ট সময় মাসিক ঘটানো, যেকোনো অপারেশন ও চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সময় পর্যন্ত মাসিক বন্ধ রাখা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে পিল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা।

তবে, নিয়মিত পিল ব্যবহারকারীদের মাসিকের সমস্যা হয় এমন ধারণা রয়েছে অনেকের মনে। যদিও চিকিৎসকরা বলছেন, এ ধারণা সঠিক নয়।

অধ্যাপক কিশোয়ার লায়লা বলেন, “পিরিয়ড বা মাসিকের সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক সময় পিল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।”

পিল খাওয়ার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এড়াতে তার পরামর্শ- একটানা জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়া যাবে না। কিছু সময় বিরতি দিয়ে পিল খেতে হবে। হয়তবা ছয়মাস খাবে এরপর দুই মাস অন্য পদ্ধতি নেবে আবার ছয় মাস খাবে।

সাধারণ পিল ও ইমারজেন্সি পিলের পার্থক্য

সাধারণভাবে চিকিৎসকরা যেসব পিল খাওয়ার পরামর্শ দেন তার সঙ্গে ইমারজেন্সি পিল বা আইপিলের পার্থক্য রয়েছে।

চিকিৎসকরা বলেছেন, ইমার্জেন্সি পিল এস্ট্রোজেন হরমোন নির্ভরশীল পিল। বিভিন্ন সময় বিশেষ পরিস্থিতি যেমন - কনডম ছাড়া যৌনমিলন, কনডম ফেটে যাওয়া, ধর্ষণের শিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে গর্ভধারণ ঠেকাতে ইমারজেন্সি পিল কার্যকর উপায়।

এটি একটি ট্যাবলেট একবার বা ১২ ঘণ্টা অন্তর দুই ডোজে ব্যবহার করতে হয়। পিল অবশ্যই অরক্ষিত যৌন মিলনের পাঁচ দিনের মধ্যে ব্যবহার করতে হয়।

এ বিষয়ে গাইনি চিকিৎসক ডা. উর্মিলা মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সাধারণ পিলের সঙ্গে ইমারজেন্সি পিলের পার্থক্য হলো - শারীরিক সম্পর্ক হোক বা না হোক কেউ যদি জন্মনিরোধ করতে চায়- তবে সে রেগুলার পিল খাবে। যখন কেউ জন্মনিরোধক পদ্ধতি নেয়নি, কিন্তু শারীরিক সম্পর্কের ফলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা আছে সেক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টার মধ্যেইমারজেন্সি পিল বা আইপিল খেতে পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।”

সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা

অনেকের মধ্যে এমন ধারণা রয়েছে যে- অন্য চিকিৎসার জন্য এটি খেলে তা সন্তান জন্মদানের সক্ষমতায় প্রভাব ফেলে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, এ ধারণাটি সঠিক নয়। এটি সন্তান জন্মদানের সক্ষমতায় পিল কোনোভাবেই প্রভাব ফেলে না।

চিকিৎসকরা বলছেন, পিল বন্ধ করার পর হয়তে পিরিয়ড শুরু হতে দেরি হয় কিন্তু ফার্টিলিটি বা প্রজনন সক্ষমতা আবার ফিরে আসে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, "তৃতীয় ও চতুর্থ এ দুই প্রজন্মের পিল দীর্ঘদিন ব্যবহার করলেও ভবিষ্যতে সন্তান ধারণের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না।"

তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা নারীদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল খাওয়া থেকে বিরত থাকা বা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেন।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনে নিরুৎসাহিত বা সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। যেমন - ৪০ বছরের বেশি বয়স হলে, যোনিপথের রক্তক্ষরণ, রক্তে অধিক কোলেস্টেরলের মাত্রা রয়েছে এমন স ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়ার বিষয়ে বাধা রয়েছে।

এছাড়া, রক্তনালির বা রক্ত জমাট বাঁধাজনিত রোগে আক্রান্ত, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস, ব্রেস্ট ক্যান্সার, লিভারের রোগ, জন্ডিস বা ক্যান্সার, আগে স্ট্রোক হয়েছে বা হার্টের রোগ আছে তাদের জন্যও বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে।

এছাড়া বড় কোনো অপারেশনের আগে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে নারীদের পিল খাওয়া শুরু বা বন্ধ রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

   

About

Popular Links

x