গত নভেম্বরে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৮ বিলিয়ন মাইলফলক স্পর্শ করেছে। মাত্র ১১ বছরে ১ বিলিয়ন মানুষ বেড়েছে পৃথিবীতে আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিমাণও।
তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ নানা দূর্যোগের কারণে পৃথিবীজুড়ে যেকোনো দেশের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে জ্বালানি ও শিল্প খাতের কার্বন নিঃসরণ কমানো নিয়ে যত আলোচনা হয়, খাদ্য ও কৃষি নিয়ে তার এক অংশও হয় না।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ব জ্বালানির পাশাপাশি গুরুতর খাদ্য সংকটে পড়েছে। এখন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তার দীর্ঘমেয়াদী চিত্রটি খুব পরিস্কার নয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে খরা, লবণাক্ততা, দাবানল ও বন্যার মতো দুর্যোগ বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় হুমকি সৃষ্টি করেছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে খাদ্যের অভাব জ্বালানি সংকটের চেয়েও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।
মিশরের শার্ম আল শেখে সদ্য সমাপ্ত কপ ২৭-এ খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি যেন আলোচনায় প্রাধান্য পায় তার তাগিদ দিয়েছিলেন কৃষকরা।
কৃষকরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সহ্য করার মতো কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে ধরে রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি সাহায্য দরকার ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের। এ লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণের এখনই সেরা সময়। ছোট কৃষকদের উন্নত প্রযুক্তি ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব এবং চরম আবহাওয়া ও দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করার সামর্থ্যের ঘাটতি অদূর ভবিষ্যতে বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থাকে চরম বিপদে ফেলতে পারে।
স্পষ্টতই, বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য এসব ছোট ও প্রান্তিক কৃষকের কোনো বিকল্প নেই। এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার ৮০% খাদ্যশস্যই উৎপাদন করেন এ ধরনের কৃষকরা। অথচ, দশকের পর দশক ধরে তারা উপেক্ষিত ও অসম্মানিত এবং বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়নের মাত্র ১.৭% পৌঁছেছে এসব ক্ষুদ্র কৃষকের কাছে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, সামগ্রিক অর্থনীতির সংকোচন, মুদ্রাস্ফিতি, রোহিঙ্গা শরণার্থী, বন্যা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটিসহ বিশ্বের মোট ৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। বাহ্যিক সহায়তা ছাড়া এই সংকট মোকাবিলার মতো সক্ষমতা ও পর্যাপ্ত সম্পদ দেশগুলোর হাতে নেই।
বীজের ওপর ব্যাপক আমদানি নির্ভরতা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো দেশের টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে বীজ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছর পার হলেও খাদ্য নিরাপত্তায় প্রধান অনুসঙ্গ বীজ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ তো নয়ই, বরং মোট বীজ চাহিদার ৯৩% আমদানি নির্ভরশীল। দেশের বাজারে প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বীজ বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে শীর্ষ চাহিদা ধান বীজের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১ সালে দেশে শাকসবজি, ধান, গম, ভুট্টা, পাট, চা, তামাকসহ বিভিন্ন বীজ বিক্রি হয়েছে ৮ হাজার ৯২৪ কোটি টাকার।
মোটা দাগে বলতে গেলে বাংলাদেশে কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। কিন্তু কৃষির প্রধান কাঁচামাল আমদানি-নির্ভর হওয়ায় একথা পুরোপুরি বলার সুযোগ নেই যে বাংলাদেশ কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিতে বাংলাদেশের নাজুক অবস্থার আসল চিত্র অর্থাৎ এ খাতে আমরা কতটা আমদানি নির্ভর তা টের পাওয়া যাচ্ছে।
একটি কৃষি নির্ভরশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত পেছনের দিকে হাঁটছে তার সবচেয়ে বড় কারণ যথাযথ কৃষি প্রযুক্তি ও মানসম্মত বীজের অভাব। আমাদের কৃষকরাও দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই কৃষি সম্পর্কে অবহিত নন। কারণ কৃষকদের আমরা এই বিষয়ে শিক্ষিত করতে পারছি না এবং তাদের যথোপযুক্ত সম্মানও দিচ্ছি না।

এরই ধারাবাহিকতায় কৃষকেরা প্রতিনিয়ত কৃষি থেকে সরে আসছেন। এছাড়া আমরা তাৎক্ষণিক সুবিধার কথা চিন্তা করে দীর্ঘ মেয়াদী অসুবিধার কথা ভাবছি না বলেই আমদানি করছি, অপরদিকে নিজস্ব উৎপাদন কমাচ্ছি।
কৃষি উপকরণের ঊর্ধ্বমুখী আমদানি-নির্ভরতা কমানোর জন্য, দীর্ঘমেয়াদে, টেকসই ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য কৃষির প্রতিটি স্তরে গুণগত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য অবশ্যই আধুনিক প্রযুক্তি এবং উপকরণের ব্যবহার সহজলভ্য করার পাশাপাশি স্থানীয় প্রযুক্তিগুলো ও দেশীয় জাতের বীজ উপযুক্ত দামে সঠিক সময়ে কৃষকদের হাতে পৌঁছাতে হবে। অন্যথায় এই আমদানি নির্ভরতার মানসিকতা কখনোই মুছে ফেলা সম্ভব নয় বরং দিন দিন নতুন ক্ষেত্রে আমদানি নির্ভরতা বাড়বে। ফলে বৈশ্বিক রাজনীতি ও ডলার সংকটে আমাদের কৃষির ওপর হুমকিটা আরও বাড়বে।
এখনই যদি আমাদের জার্মপ্লাজম সেন্টারে স্থানীয় জাতগুলো সংরক্ষণ করা না হয় ভবিষ্যতে আমরা আরও বেশি আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ব। জার্মপ্লাজম সেন্টারগুলো তখনই কাজে দেবে যখন আমরা গবেষণায় মনোযোগী হব এবং স্থানীয় সমস্যা অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে স্থানীয় উপকরণ দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব।
অদূর ভবিষ্যতে আমাদের রিসোর্সের অভাবে পড়তে না হয় সেজন্য স্থানীয় ফসলের জাতগুলোর সংরক্ষণ, সিড মাল্টিপ্লিকেশন প্রোগ্রামগুলোকে আরও জোরদার করা এবং সঠিক সরবরাহ ব্যবস্থার নিশ্চিতের মাধ্যমে উপযুক্ত দাম নির্ধারণ হতে পারে দীর্ঘমেয়াদে কৃষিতে প্রকৃত স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের উপায়।
এজন্য ভর্তুকি দিয়ে হলেও কৃষিতে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন যাতে পরবর্তীতে আমদানি নির্ভরতা কমে।
শুধুমাত্র গুণগত মানসম্পন্ন ভালো বীজের ব্যবহার করা গেলে সার এবং সেচ এর পরিমাণ কমিয়ে ২০% পর্যন্ত উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এছাড়াও, আমদানি নির্ভর সারের ওপর চাপ কমাতে যদি জৈব সারের উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়ানো যায় তাহলে আমাদের সারের চাহিদা পূরণ হবে পাশাপাশি মাটির পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে।
কৃষিতে যথেচ্ছ বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে আমরা মাটি এবং ফসলের ভয়ানক ক্ষতি করেছি। এর পুনরাবৃত্তি রোধে দেশীয় প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কীটনাশক ব্যবহারে কঠোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

আইপিসিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈচিত্র্য আনার কোনো বিকল্প নেই।
বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় শস্য উৎপাদন, রাসায়নিকের ব্যবহার কমানো এবং স্থানীয় বাজারের সঙ্গে উৎপাদক বা কৃষক শ্রেণির শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে কৃষিকে জলবায়ু সহিষ্ণু করা সম্ভব। প্রায় ৬১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খাদ্য উৎপাদনে ভর্তুকি হিসেবে দেওয়া হয়। এর সবচেয়ে বড় অংশ যায় উচ্চ রাসায়নিকযুক্ত বাণিজ্যিক ও শিল্পমুখী কৃষি উৎপাদনে, যা নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্বের বড় বড় করপোরেশনগুলো। এ ধরনের কৃষি উৎপাদন মানুষ ও পরিবেশ উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।
যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অন্যতম প্রধান শস্যভাণ্ডার ইউক্রেন থেকে সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক খরাসহ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্য উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়াতে বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দাম রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। এর ফলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ভবিষ্যতে হয়তো টাকা দিয়েও প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য পাওয়া যাবে না। জলবায়ু পরিবর্তনে সব থেকে হুমকির মধ্যে পড়বে কৃষি।
বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবগুলো সহ্য করার অবস্থাতে নেই। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, জলবায়ু সহনশীল বীজ উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি, সর্বোপরি কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে ভবিষ্যতে প্রতিটি মুখের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং অর্থনীতির স্থিতিস্থাপকতা আনয়নে এখাতে ব্যাপক বিনিয়োগ প্রয়োজন। বাংলাদেশে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বীজ গবেষণার মাধ্যমে জাত উন্নয়নের চেষ্টা করছে কিন্তু সে সংখ্যাটা নেহাতই নগণ্য।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি, লবণাক্ত জমির পরিমাণ বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি জনিত জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়ের সাথে সহনশীল জাত তৈরিতে আমাদের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং এ বিষয়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের বীজ নীতিকে এই সময়ের জন্য যথাযথ করে তৈরি করা না গেলে ভবিষ্যতে আমাদের পরনির্ভরশীল হয়ে অন্যের দয়ায় বেঁচে থাকতে হবে।
আমরা যেভাবে সম্পূর্ণভাবে আমদানিনির্ভর হয়ে উঠছি তাতে ভবিষ্যতের যেকোনো দুর্যোগে হয়ত আমাদের দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়তে হতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, টাকা রান্না করে বা চিবিয়ে খাওয়া যায় না।
উসওয়াতুন হাসানা
সিনিয়র লেকচারার, কৃষিবিদ্যা বিভাগ, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ
*******
মো. জহুরুল আল মামুন
জলবায়ু গবেষক, সেন্টার ফর ইনভায়রনমেন্ট এন্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ (সিইপিআর)
প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকদ্বয়ের অভিজ্ঞতালব্ধ ব্যক্তিগত মতামত। ঢাকা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ এর জন্য দায়ী নয়।