গত বছর যে সংক্রামক রোগটিতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে, সেটির নাম যক্ষ্মা। ২০২২ সালে সারাবিশ্বে যক্ষ্মা রোগে ১৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা ওই বছরে বিশ্বজুড়ে কোভিডে মৃত্যুর চেয়ে বেশি সংখ্যক। তবে, ধনী দেশগুলোতে এই রোগে মৃত্যু নেই বললেই চলে।
দারিদ্রপীড়িত সুবিধাবঞ্চিত দেশগুলোতে এই রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি।
বিশ্বনেতারা দীর্ঘদিন ধরে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন। জাতিসংঘের বৈশ্বিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। যেখানে এই সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের শতাধিক লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে যক্ষ্মা নির্মূলের প্রতিশ্রুতিও রয়েছে। তবে, যক্ষ্মা পুরোপুরি নির্মূল করার ক্ষেত্রে বিশ্ব আসলে এখনও কয়েক দশক পিছিয়ে।
প্রকৃতপক্ষে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের এসডিজির শতাধিক প্রতিশ্রুতির প্রায় সবগুলোতেই ব্যর্থ আমরা।এসডিজিতে বিশ্বনেতারা ১৬৯টি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। এসিডিজিতে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিরসন, রোগমুক্তি, যুদ্ধের অবসান এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসের মতো বেশকিছু বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। তারা সবুজায়নের মতো কিছু দূরবর্তী লক্ষ্যমাত্রাও সংযুক্ত করেছেন।তবে, ১৬৯টি লক্ষ্যের অর্থ বিশেষ কোনো বিষয়ে অগ্রাধিকার না থাকার মতোই। আর বর্তমান অগ্রগতি অনুযায়ী, এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এই শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লেগে যাবে।
প্রতিশ্রুত এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক সময় পার হয়ে গেলেও অর্জনের অর্ধেকের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারিনি আমরা। তাই, কোন ক্ষেত্রে এখন বেশি জোর দিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে, সেটি নির্ধারণ করা জরুরি।
এ কারণেই আমাদের কোপেনহেগেন কনসেনসাসের গবেষকরা এসডিজি'তে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি করা যেতে পারে এমন ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করতে বিগত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, যক্ষ্মা রোগ নির্মূলে রাতারাতি কোনো নাটকীয় পরিবর্তন সম্ভব না হলেও এসডিজির বাকি সময়ে এই খাতে অগ্রাধিকার দিলে কার্যকরী ফল পাওয়া যাবে।
বিশ্বের প্রায় এক চতুর্থাংশ মানুষ যক্ষ্মার জীবানু বহন করে। এমনকি ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দশজনের একজন এটি বহন করে চলেছে। তবে, উন্নত দেশগুলোর মানুষের জন্য যক্ষ্মা তেমন ক্ষতিকারক না হলেও দারিদ্রপীড়িত দেশগুলোতে এর পরিণতি ভয়াবহ। বলা যায়, যক্ষ্মা ক্ষুধা ও দারিদ্রের রোগ।
প্রতিবছর বিশ্বে এক কোটিরও বেশি মানুষ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়। প্রয়োজনীয় সুবিধা ও উপকরণ না থাকার পরও ২০২১ সালে বিশ্বে ৬০ লাখ যক্ষ্মা রোগী চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা ৩ লাখ। চিকিৎসা না পেলে যক্ষ্মা আক্রান্ত এসব রোগীদের প্রায় অর্ধেকই মারা যাবে। যারা বেঁচে থাকবেন, তারা সংক্রমণ ছড়াতে থাকবেন। একজন যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে বছরে গড়ে ৫ থেকে ১৫ জন মানুষ সংক্রমিত হতে পারে।
২০২১ সালে চিহ্নিত হওয়া এই ৬০ লাখ লোককে চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই রোগের জন্য টানা ছয় মাস ঔষধ সেবন করতে হয়। কিন্তু সেবনের প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই যক্ষ্মার অন্যতম প্রধান লক্ষণ জ্বর ও ওজন হ্রাস কমতে থাকে, তাই অনেকেই পুরো মেয়াদের ঔষধ না খেয়েই চিকিৎসা ছেড়ে দেন।
যখন কেউ খুব অল্প সময়ে চিকিত্সা বন্ধ করে দেয়, তখন এটি শুধু এই রোগটি অন্যদের মাঝে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় না। বরং এর ফলে যক্ষ্মার জীবানুর ঔষধ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও বেড়ে যায়। যার ফলে ওই ব্যক্তি পুনরায় চিকিৎসা শুরু করলে তখন সুস্থ হতে ১৮ থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত সময়ে লেগে যেতে পারে, যা বেশ ব্যয়বহুলও।
তবে এইক্ষেত্রে আরও অনেক ভালো করা সম্ভব। বেশি সংখ্যক রোগী শনাক্ত করা গেলে চিকিৎসার আওতায় আনা রোগীদের সংখ্যাও বাড়বে। আমাদের কোপেনহেগেন কনসেনসাসের গবেষণায় দেখানো হযেছে, বার্ষিক অতিরিক্ত ৬.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করলেই এই অর্জন সম্ভব। আর এই পরিমাণ অর্থ আসলে এ খাতের জন্য ইতোমধ্যে প্রতিশ্রুত বরাদ্দের চেয়েও কম। ২০১৮ সালে এই খাতের বরাদ্দ কমে গেলে জাতিসংঘ তা ২০২২ সালের মধ্যে ৭-৮ বিলিয়ন ডলার বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।
বার্ষিক অতিরিক্ত ৬.২ বিলিয়ন ডলার যক্ষ্মা নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ করতে সহায়ক হবে, যা যক্ষ্মা নির্মূলে বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে। এই বরাদ্দ নিশ্চিত হলে যক্ষ্মা আক্রান্ত ৯৫% রোগীই শনাক্ত করা যাবে। আক্রান্ত রোগীরা যাতে ছয় মাসের চিকিৎসা কোর্স সম্পন্ন করে সেজন্য খাদ্য, বস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের উপহার প্রণোদনা চালু করা যেতে পারে। এই কাজে স্মার্টফোনের অ্যাপও কাজে লাগানো যেতে পারে।
অতিরিক্ত এই বিনিয়োগ উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করবে। এর ফলে এক দশকে ৫ কোটি যক্ষ্মা রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা যাবে এবং সাড়ে তিন কোটি লোক যক্ষ্মা থেকে মুক্তি পাবেন।
এই বিনিয়োগ যক্ষ্মায় মৃত্যু ৯০% কমিয়ে দেবে। কার্যত এর ফলে যক্ষ্মা নিশ্চিহ্ন হবে, যা আসলে আরও কয়েক দশক আগে করা উচিত ছিল। এখনই এই বিনিয়োগ নিশ্চিত করা গেলে এই শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ২ কোটি ৭০ লাখ প্রোণ বাঁচানো যাবে। যার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, এই খাতে ব্যয় করা প্রতি ডলারের বিপরীতে ৪৬ ডলারের সামাজিক সুবিধা নিশ্চিত হবে।
বৈশ্বিক অবহেলা যক্ষ্মা রোগকে সংক্রামক ঘাতক হতে দিয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যক্ষ্মা নির্মূল বিশ্বের জন্য অন্যতম কার্যকর নীতি হওয়া উচিত। আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে অনেক লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, যার মধ্যে যক্ষ্মা মোকাবিলা একটি। তবে বিশ্ব মানবতার কল্যাণে যক্ষ্মা নির্মূর্লকে অবশ্যই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার তালিকায় রাখতে হবে।
ড. বিওন লম্বোগ কোপেনহেগেন কনসেনসাসের প্রেসিডেন্ট এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির হুভার ইনস্টিটিউশনের ভিজিটিং ফেলো।
এই নিবন্ধ ঢাকা ট্রিবিউনের জন্য জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. বিওন লম্বোগের লেখা বিশেষ সিরিজের পঞ্চম অংশ। সিরিজের আগের লেখাগুলো পড়ুন যথাক্রমে-
- বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজন দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব
- এসডিজি বাস্তবায়নে যে ভুলগুলো করেছে বিশ্ব
- শিশু ও মাতৃমৃত্যু কমলে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে