ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসায় জেনেটিক টেস্ট এখন অবশ্য প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। ক্যান্সারের মূল কারণ আমাদের জিনের কিছু ক্ষতিকর পরিবর্তন যা পরবর্তীতে আমাদের কোষের বিপাকপ্রক্রিয়াসহ নানান অসঙ্গতি তৈরি করে। এসব অসঙ্গতিরই চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে ক্যান্সার। এই পরিবর্তন যে কারো যেকোনো সময়ে হতে পারে। ফলে আমরা কেউ-ই ক্যান্সার ঝুঁকির বাইরে নই। তবে কেউ কেউ ক্ষতিকরভাবে পরিবর্তিত জিন নিয়েই জন্মগ্রহণ করে, ফলে তাদের ভেতর ক্যান্সার আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ক্যান্সার রোগীদের ১০% পর্যন্ত এমন পরিবর্তন বহন করে। তাদেরকে আলাদাভাবে ব্যবস্থাপনার অধীনে আনতে হবে। এসব কিছু বিবেচনায় রেখে জেনেটিক টেস্ট করা হয়। মূলত তিনটি কারণে জেনেটিক টেস্ট করা জরুরি হয়ে পড়ে- প্রথমত. ক্যান্সারটি কোন ধরনের তা জানা (শুধু টিস্যু পরীক্ষা করে যে তথ্য জানা যায়, তা যথেষ্ট নয়)। দ্বিতীয়ত. ক্যান্সারের চিকিৎসায় যে ওষুধ ব্যবহার করা হবে তা কতখানি রোগীর উপকারে তা আগে থেকেই বুঝার চেষ্টা করা। তৃতীয়ত. ক্যান্সারটি আসলে বংশগত কিনা, তা নিশ্চিত করা। বংশগত হলে পরিবারের অন্য সদস্যদের এ বিষয়ে সচেতন করা, এবং তাদেরকে চিকিৎসা নজরদারিতে আনা।
কিন্তু সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে টেস্ট করা না হলে, কিংবা কোন টেস্ট রোগীর উপকারে লাগবে, তা ভালোভাবে নিশ্চিত না হয়ে টেস্ট করাতে দিলে রোগীর ভুল চিকিৎসা কিংবা অর্থ অপচয়ের ঝুঁকি আছে। ক্যান্সারের টেস্ট করার নামে একটা দীর্ঘ সময় ধরে ভারতে বাংলাদেশ থেকে স্যাম্পল পাঠানো হতো। এই স্যাম্পল পাঠানোর কোন বৈধ রুট নাই। ফলে স্যাম্পল পাঠানোর পথে কোথাও গোলমাল হলে তা দেখার কেউ নাই। ভারতের যেসব ল্যাবে স্যাম্পল টেস্ট করা হতো বা হয়, তাদের সবগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরীক্ষিত নয়। ফলে যেসব রিপোর্ট দেওয়া হয় বা হয়েছে এতদিন, সেখানে নানান গোজামিলের সম্ভাবনা আছে্। জেনেটিক টেস্টের রিপোর্ট সঠিকভাবে না হলে যেমনটি বলেছি, রোগীর ভুল চিকিৎসা হতে পারে- যে ওষুধটি তার কাজে লাগবে হয়তো সেটি দেওয়া হলো না, কিংবা যা কাজে লাগবে না, তা দেওয়া হলো- উভয় ধরনের ভ্রান্তিরই ঝুঁকি আছে।
অনেক টেস্ট এমন ফলাফল দেয়, যার ওপর ভিত্তি করে ডাক্তার কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। অর্থাৎ এই টেস্ট-টি রোগীর করা না করা সমান কথা। অথচ, জেনেটিক টেস্ট বাবদ বিপুল অর্থ নেওয়া হয়। টেস্টগুলো এমন- আমাদের দেশের অনেক ডাক্তারও এগুলোর ভিত্তি সম্বন্ধে সম্পর্ণূ অবগত নন। ফলে রোগীকে সম্পূর্ণভাবে সহযোগিতা করাটা তাদের সামর্থ্যের বাইরে। ডাক্তারগণ ভালো উদ্দেশ্যে টেস্ট করতে দিলেও, তাদের সীমাবদ্ধতা এবং টেস্টের নির্ভরযোগ্যতার অভাবে রোগীরা সবসময় উপকার পান না। অনেক টাকা খরচ করে টেস্ট করার পর দেখা গেলো- তার প্রয়োগ নেই। রোগীর প্রশ্নের উত্তর দিতে বিব্রত হন ডাক্তার। এমন পরিস্থিতিতে রোগীরা অর্থনৈতিক ও মানসিক নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন।
এই পরিস্থিতির পরিবর্তন দরকার
ভালো বিষয় হচ্ছে দেশে এখন বেশ কয়েকটি জায়গায় ক্যান্সারের জেনেটিক টেস্ট করা হয়। বেসরকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হয়েছে, একইসাথে কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও এই টেস্ট করার সামর্থ্য অর্জন করেছে। এমন উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠন হচ্ছে- ঢাকার আইদেশি (idesHI), আইসিডিডিআরবি(ICDDRB), বগুড়ার টিএমএসএস (TMSS) মেডিকেল কলেজ। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তিগত সামর্থ্য তৈরি হয়েছে। এখন দরকার সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং এই টেস্টগুলোর মূলনীতি বুঝে প্রযুক্তির ব্যবহার। অনেক টেস্ট আছে যা অল্প খরচে করা যায়। জেনেটিক টেস্ট মানেই তা ব্যয়বহুল এমন কিন্তু নয়। ধরা যাক, কোলন ক্যান্সারের কথা। এই ক্যান্সারের ওষুধ দেয়ার আগে KRAS, BRAF নামে দুটো জিনের টেস্ট করা দরকার পড়ে। এই দুটো জিন নিয়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছি। আমাদের হিসেবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে জেনেটিক টেস্ট করতে ৫ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। আর সরকার যদি একটু মনোযোগ দিয়ে প্রয়োজনীয় উপকরণের ট্যাক্স কমিয়ে দিতো, তাহলে এই খরচ হয়তো আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যেই করা যেতো। অথচ দেশে এই টেস্টের খরচ কখনো কখনো দশ হাজার থেকে পনের হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। এমন চিত্র বেশিরভাগ টেস্টের ক্ষেত্রেই। প্রযুক্তিটি ভালোভাবে বুঝা, লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করা, যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানে ব্যয়বহুল প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহার না করা- এই বিষয়গুলো আয়ত্তে না থাকলে ডাক্তার এবং ডায়াগনস্টিক সার্ভিস- কেউই ভালোভাবে জেনেটিক টেস্টের সেবা রোগীদের উপকারে কাজে লাগাতে পারবেন না।
এজন্য দরকার সঠিক প্রশিক্ষণ। আমাদের দেশে ক্যান্সারের জেনেটিক টেস্ট নিয়ে সবচেয়ে বেশি পড়াশোনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলিজি বিভাগ কিংবা বায়োকেমেস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ডাক্তারগণ নয়। ডাক্তারগণ ক্যান্সার রোগ নিয়ে পড়েন, কিন্তু জেনেটিক টেস্টের প্রযুক্তি ও তার প্রয়োগ নিয়ে দেশের মেডিকেল কারিকুলাম এখনো অত্যন্ত পিছিয়ে আছে। এমন অব্স্থায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণেই জেনেটিক টেস্ট ও তার প্রয়োগ নিয়ে এগিয়ে যাবার সুযোগ বেশি। এজন্য ডাক্তারদেরকে জায়গা তৈরি করতে হবে, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কাজ করতে হবে নতুন জনবল তৈরি করার জন্য। তবে এখানেও কিছু কাজ করা বাকি আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে যে পড়াশোনা হচ্ছে, তা সরাসরি কাজে লাগানোর জন্য যথেষ্ট নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলিক বিষয়গুলো শেখানো হলেও তার প্রয়োগিক দিক, বিশেষ করে রোগীর সাপেক্ষে পুস্তকীয় জ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে আমাদের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেই ঘাটতি পুরণ করার উদ্যোগ নিতে হবে।
কীভাবে এই লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে, তা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা দিচ্ছি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যান্সারের মলিকুলার বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা ও পাঠদান করছি প্রায় ৫ বছর ধরে। তার আগে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনকোলজি বা ক্যান্সারবিদ্যায় পিএইচডি অর্জন করেছি। কিন্তু এত কিছুর পরও রোগীর সাপেক্ষে আমার অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোথাও একটা ঘাটতি আমি নিজের ভেতর বোধ করছিলাম। কোন জেনেটিক টেস্ট কিভাবে রোগীর জন্য, তার পরিবারের জন্য কাজে লাগতে পারে- এ ব্যাপারে প্রায়োগিক দিকটি আমার কাছে পুরোপুরি স্বচ্ছ ছিলো না। এর মূল কারণ, রোগীদের সাথে আমার সরাসরি কোন মিথস্ক্রিয়া না হওয়া। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য পাই রোগীর স্যাম্পল- কখনো এই স্যাম্পল একটু খানি রক্ত, কখনো তা ক্যান্সারের একটু টিস্যু। রোগীর সাথে যোগাযোগ কেবল ডাক্তারের। আমার নয়। দেশের বিদ্যমান ব্যবস্থায় রোগীর ক্যান্সারের বিস্তারিত ধরন, তার পরিবারের ইতিহাস ইত্যাদি আমার জানার সুযোগ ছিলো না। কিন্তু এটা জানা না থাকলে আমার পক্ষে রোগীর জন্য সর্বোচ্চ সেবাটা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এই দূরত্ব আমাদের রোগীদের আদর্শ সেবা থেকে বঞ্চিত করছে।
এই দূরত্ব ঘোচানোর জন্য আমি নিজেকে প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নিই। জেনেটিক টেস্টের পাশাপাশি একজন মলিকুলার অনকোলজিস্ট হিসেবে রোগীর সাথে আরো যুক্ত হবার জন্য আমি নিজের প্রস্তুত করবো- এই প্রতিজ্ঞা থেকে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ক্যান্সার সেন্টার (National Cancer Centre Singapore-NCCS)-এ ক্যান্সার জেনেটিক সার্ভিসের ওপর ফেলোশিপের জন্য আবেদন করি। যদিও এখানে বেশিরভাগক্ষেত্রে ডাক্তারদের ফেলোশিপ দেওয়া হয়, তবে বাংলাদেশে জেনেটিক টেস্ট আরো রোগীবান্ধব ও প্রসারিত করার প্রতিশ্রুতি বিবেচনায় আমি বিশেষ ফেলোশিপের সুযোগ পাই। ছয় মাসের বেশি সময় ধরে এই ফেলোশিপের ট্রেনিং জেনেটিক টেস্টের প্রয়োগ রোগী ও তার পরিবারের ওপর কী ভূমিকা রাখে সে বিষয়ে সরাসরি দক্ষতা অর্জন করার সুযোগ দিয়েছে। জেনেটিক টেস্ট ব্যাখ্যা করা, এর ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি আসলে জেনেটিক কাউন্সেলিং এর অধীনে পড়ে। এ বিষয়গুলো এখন অনেক বেশি পরিষ্কার আমার কাছে। প্রত্যক্ষভাবে কিংবা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শতাধিক কেস স্টাডিতে অংশ নিয়ে আমি জেনেটিক টেস্টে-কে একজন রোগীর সাথে সরাসরি যুক্ত করার প্রক্রিয়া শিখতে পেরেছি। জেনেটিক ক্লিনিকে দেখার সুযোগ হয়েছে রোগীর কাছে জেনেটিক টেস্ট-এর যৌক্তিকতা কিংবা ফলাফল ব্যাখ্যা করলে কীভাবে তারা প্রতিক্রিয়া দেখায়। একটি নেগেটিভ টেস্ট কীভাবে একজনকে আনন্দিত করে, একটি পজিটিভ টেস্ট কীভাবে একজন চিন্তাগ্রস্ত করে, কী কী বিষয় মাথায় রেখে একজন রোগী জেনেটিক টেস্টের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়- এসব বিষয়ে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়ে এখন আমি দেশে এই বিষয়ে সরাসরি রোগী ও ডাক্তারদের সাথে কাজ করতে প্রস্তুত। একজন রোগীর জেনেটিক টেস্ট দেবার আগে, কোন কোন জিন তার টেস্টে রাখা দরকার, কোনগুলো দরকার নেই, টেস্ট রেজাল্ট পাবার পর তার জন্য কী কী করণীয় আছে- এসব বিষয়ে সরাসরি পরামর্শ দেবার দক্ষতা আমার ভেতরে এখন তৈরি হয়েছে বলে আমি বোধ করি, যা এই ফেলোশিপের আগে আমার মধ্যে ছিলো না।
আমার নিজের এই অভিজ্ঞতার আলোকে দেশে এখন নতুন কিছু করার ব্যাপারে আরো বস্তুনিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ ও আত্মবিশ্বাসী।
নিচের কয়েকটি বিষয় মাথায় আমরা সামনে রেখে এগাতে পারি:
১. আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, জেনেটিক টেস্ট এখন যতটা ব্যয়বহুল, ততটা থাকার কোন প্রয়োজন নেই। আমাদের নিজেদের জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা এই টেস্টের খরচ কমাতে পারে।
২. জেনেটিক টেস্ট একজন রেগী ও তার স্বজনদের কাজে না লাগলে সেই টেস্ট দেওয়া যাবে না। একজন ডাক্তার যৌক্তিকতা সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে টেস্ট দিতে পারেন না। এটা নৈতিকতার পরিপন্থি হিসেবে বিবেচিত হবে।
৩. টেস্ট রেজাল্ট ব্যাখ্যা করা ও এর ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাদের লোকবল ট্রেনিং করাতে হবে। ডাক্তারদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই কাজে অংশ নিতে পারে, তবে তাদেরকে অবশ্যই ট্রেনিং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে হবে।
৪. বাংলাদেশে এখন অত্যন্ত জরুরি ক্লিনিক্যাল জেনেটিক টেস্টের একটি নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করা। এখানে আমাদের কাজ করতে হবে। নইলে রোগীদের বঞ্চনা ঠেকানোর উপায় নেই।
৫. দেশে জেনেটিক টেস্ট করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এই কাজে যেসব যন্ত্রপাতি ও রিএজেন্টস দরকার হয়, তার ওপর ট্যাক্স কমানোর মাধ্যমে এই টেস্টের ব্যয় কমানো সম্ভব।
এসব বিষয়ে নীতিনির্ধারক ও ডাক্তারদের সাথে একযোগে কাজ করতে হবে আমাদের। যার যেখানে দক্ষতা আছে, সেটাকে একসাথে করলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। সকলের সম্মিলিত উদ্যোগে দেশে এই সেবা সঠিকভাবে রোগীদের সেবায় প্রসারিত হোক- সেটাই একমাত্র প্রত্যাশা।