গাজা উপত্যকায় নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর হামলা অব্যাহত রয়েছে। সব শ্রেণির মানুষ শিকার হচ্ছে এই আগ্রাসনের। স্বভাবতই পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত খারাপের দিকে যাচ্ছে। নিরীহ ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলি সেনারা যে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে, তা মানব সভ্যতার ইতিহাসে নজিরবিহীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর সেই ইহুদিরা দীর্ঘ সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর যে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, তা হিটলারের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। ফিলিস্তিনিরা আজ আপন দেশে পরবাসী। ওই এলাকায় যাদের রয়েছে চার হাজার বছরেরও বেশি সময়ের বসতির ইতিহাস; তারাই এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তুর মতো জীবনযাপন করছে। উড়ে এসে জুড়ে বসা ইসরায়েলিরা এখন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। এরই বিরুদ্ধে এখন সারাবিশ্বের মানুষ প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছে। সারাবিশ্বের মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষও চায় ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বর্বরতার অবসান হোক। মানবতার এ চরম বিপর্যয়ে বিশ্ববিবেক আজ প্রচণ্ডভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ও অসহায়।
তাদের বর্বরতায় গাজায় এখন সম্পূর্ণ মানবিক বিপর্যয় শুরু হয়েছে। তারা গাজাবাসীর ঘরবাড়ি ও অস্থায়ী তাঁবুতে হামলা চালায়। ধ্বংসস্তূপে এখনো আটকা মানুষ। চলছে মরদেহ ও জীবিতদের উদ্ধার চেষ্টা। পুরো গাজায় প্রায় একই চিত্র। বেঁচে থাকার খাবার নেই। পানি নেই। নেই চিকিৎসার ব্যবস্থা। যেটুকু চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে, সেখানে আহতদের উপচে পড়া ভিড়। চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ও স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব। এমনকি গত এক মাসে গাজায় একটিও খাবার, চিকিৎসাসামগ্রী বহনকারী সহযোগিতার ট্রাক প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। পিতামাতারা শিশুসন্তানদের মুখে একটু খাবার তুলে দেওয়ার জন্য লড়াই করছেন। এমন অবস্থায় ইসরায়েলি নৃশংস আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পৃথিবীর দেশে দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায় গণমাধ্যমগুলোয়। ঘৃণা প্রকাশ করতে দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসরায়েলি নৃশংসতার প্রতিবাদে সোচ্চার নেটিজেনরা। বাংলাদেশেও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন ও প্রতিবাদ মিছিলের মতো কর্মসূচি পালন করে। বিশ্বনেতৃত্ব ও সংস্থাগুলোকে এ আগ্রাসন বন্ধে কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে গত ১৮ মার্চ থেকে গাজায় নতুন করে হামলা শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরাইলের হামলায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০,৬৯৫।
এটা পরিষ্কার, গাজায় ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করাই ইসরায়েলের লক্ষ্য। গভীর পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, পুরো পৃথিবী মানবতার বিরুদ্ধে এ অপরাধ দেখছে দর্শকের ভূমিকায়! ইউনিসেফ সতর্ক করে জানিয়েছে, গত ১৮ মার্চ থেকে ফের হামলা শুরু করার পর থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ শিশু নিহত হচ্ছে। গাজার ১০ লাখেরও বেশি শিশু এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পাচ্ছে না জীবন রক্ষাকারী সহায়তা। ইসরাইলের কারণে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনি জনতার যেসব মৌলিক অধিকার-তাও লঙ্ঘিত হচ্ছে চরমভাবে। হাসপাতালগুলোতে আহত মানুষের উপচে পড়া ভিড়; কিন্তু চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের সুযোগই নেই।
আমরা মনে করি, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী মানবতার বিরুদ্ধে যা করছে, তা নিঃসন্দেহে আধুনিক সভ্যতার এক নগ্নরূপ। মানবতার সঙ্গে এক পৈশাচিক তামাশা। এর দায় এড়াতে পারে না বিশ্বনেতৃত্ব। আমাদের প্রত্যাশা, দ্রুত এ আগ্রাসন বন্ধে তৎপরতা বাড়বে। আর যেন গাজায় রক্ত না ঝরে; দেখা যাবে কার্যকর উদ্যোগ। মনে রাখতে হবে এ আগ্রাসন শুধু ফিলিস্তিনি নয়, বিশ্বমানবতা জন্যই হুমকির।
সভ্যতার যা কিছু অর্জন, ফিলিস্তিনে নিরীহ মানুষের ওপর ইসরায়েলের বর্বরতায় প্রতি মুহূর্তে তা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। পরিতাপের বিষয়, দৃশ্যমান এই পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ বিশ্বের ক্ষমতাধরদের তরফ থেকে নেওয়া হচ্ছে না।
ফিলিস্তিনে চিকিৎসাকর্মীদেরও টার্গেট করে হত্যা করার কারণে রয়েছে চিকিৎসকের ঘাটতি। এই চিকিৎসকরা বোমা বর্ষণকালে আহতদের দিকে ছুটে যান। অন্যদের বাঁচাতে গিয়ে তারা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিলেন। গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি যানবাহনের একটি বহর লক্ষ্য করে হামলা চালায়। জরুরি চিকিৎসাকর্মীকে হত্যার যে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, তা খণ্ডচিত্র মাত্র, ইসরায়েলের এমন পৈশাচিকতার নজির রয়েছে অসংখ্য।
ক্ষমতার মোহে নিমজ্জিত বিশ্বনেতারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও সাধারণ মানুষ এই বর্বরতার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বনেতারা নিশ্চুপ এখনো, সেই আমজনতা এই অনাচারের সীমা টানতে পথে পথে বিক্ষোভে নেমেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসনের প্রতিবাদ এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে দেশজুড়ে বিক্ষোভ মিছিল ও ক্লাস-পরীক্ষা বয়কটের কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
দেখো বিশ্ববাসী! ফিলিস্তিনে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে, তোমাদের তথাকথিত মানবতা। নির্বাক জাতিসংঘ, নীরব অধিকারকর্মী- সবাই যেন বিবেকহীন নাটকের অংশ মাত্র। রক্তের স্রোত বইছে গাজার পথে, অথচ বিশ্ব দেখে চোখ বন্ধ করে। তাই তো এতোটা বিবেকহীন, নির্লজ্জ নিরবতা! রাসুল সা কে ইহুদীরা তিনবার হত্যা করতে চেয়েছিল। ৭০ হাজার নবি-রাসুলকে তারা হত্যা করেছিল। নূরানি চেহারার ইউসুফ (আ.)’কে হত্যা করতে ও তাদের হাত কাঁপেনি। ফিলিস্তিন নয় সারা পৃথিবীর এক হাজার কোটি মানুষকে ও তারা হত্যা করতে দ্বিধা করবে না। জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তি মহান আল্লাহ তাদের হাতে দিয়েছেন। সমগ্র পৃথিবীর মানুষ হত্যা করতেও তারা দ্বিধা করবে না। আল্লাহ তাদের সৃষ্টি করেছেন মানবতা হত্যা করার জন্য? বিশ্বের একমাত্র নেতা হিটলার এ কথা বুঝতে পেরেছিলেন। দুর্ভাগ্য মুসলমানরা বোঝেনি। ফিলিস্তিনের পাশে কেউ দাঁড়ালো না! আজকে মিছিলে যাওয়ার আগে শপথ নিন জীবনে কোনদিন ইসরাইলের কোন পণ্য গ্রহণ করবেন না।
আমাদের মনে রাখতে হবে সাধ্য থাকার পরও তীর বা ধনুক দিয়ে পারমাণবিক বোমা মোকাবিলা করার মানেই হচ্ছে মূর্খতা। কোনো অবলম্বন না থাকলে ওটা ভিন্ন কথা। ইসরায়েলের জনসংখ্যার প্রতি ১০ লাখের মধ্যে কমপক্ষে ১০ হাজার জন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বৈজ্ঞানিক বা সমপর্যায়ের। তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে আমরা মিছিল মিটিং, তাদের ব্র্যান্ড চিহ্নিত করন বা এই ধরনের কিছু একটা করি। সর্বশেষ হয়তো আল্লার নিকট মোনাজাত কবে বলি, “হে আল্লাহ সূরা ফিল এর সেই আবাবিল পাখি আবার প্রেরণ করে ইসরায়েলকে ধ্বংস কর”। ইসলামিক বক্তাগণ ইমাম মাহাদী এবং ঈসা (আ:) এসে আমাদেরকে রক্ষা করবেন এই বয়ান বেশি করে যাচ্ছেন। ইহুদিদের প্রতিপক্ষ হিসেবে আমাদেরও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রগামী হতে হবে, এ কথাটি কমই বলেন। আমদের জ্ঞান বিজ্ঞানে ও শক্তিমত্তায় প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হবে। আল্লাহর ওপর ভরসা অবশ্যই রাখতে হবে, এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেই বলছি। প্রতিপক্ষকে মোকাবিলার জন্য যথাযথ চেষ্টার পর বলতে হবে আল্লাহই যথেষ্ট। যে জাতি তার নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সচেষ্ট থাকে, আল্লাহতায়ালা তার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটান, এই অর্থে আল্লাহ যথেষ্ট। আর দেরি না করে অপশক্তি মোকাবিলায়, সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত জানমাল ও সময় ব্যয় করে এ যোগ্যতা আমাদের বাংলাদেশকেও অর্জন করতে হবে।
ঈমানদারের তিনটি চিহ্ন রয়েছে। প্রথম শ্রেণির ঈমানদার অন্যায়ের বিপক্ষে হাতে মোকাবিলা করবে। দ্বিতীয় শ্রেণির ঈমানদার অন্তত কথা বলার মাধ্যমে বা বাকশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে। তৃতীয় শ্রেণির ঈমানদার অন্তরের অন্তস্থল হতে ঘৃণা করবে। গাঁজাবাসীর বিষয়টি এখন ঈমানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গাঁজা হতে পরিবার সমেত প্রস্থান করা এক যুবকের ঘটনা মনে পড়ে গেল। নিম্নে তা কবিতা আকারে তুলে ধরা হলো।
যুবক যখন গাজা হতে চলে আসে,
রেখে যায় তার শৈশব দেরাজে,
আর রান্নাঘরের টেবিলে।
নিজের ঘোড়াটিকে সে রেখে যায়
এক প্লাস্টিকের ব্যাগে।
ঘড়ির দিকে না তাকিয়ে চলে যায় সে।
সেটা ছিল দুপুর নাকি সন্ধ্যা, মনে নেই তার।
তাদের ঘোড়া একাকি রাত কাটায়,
রাতের খাবারের জন্য নেই পানি, নেই কোনো শস্যদানা।
সে হয়তো ভেবে থাকবে তারা গিয়েছি কোথাও রান্না করতে, অবেলায় আসা কোনো অতিথির জন্য অথবা যুবকের বোনের দশম জন্মদিনে বানাতে কেক।
বোনের হাত ধরে সে হেঁটে যায়,
সেই পথ ধরে যার কোনো শেষ নেই।
তারা গায় জন্মদিনের গান।
যুদ্ধবিমান করে প্রতিধ্বনি স্বর্গ জুড়ে।
ক্লান্ত বাবা-মা হেঁটে চলে পেছনে,
পিতা যুবকের বুকে ধরে রাখে
তাদের বাড়ি আর আস্তাবলের চাবি।
উদ্ধার স্টেশনে এসে পৌঁছুই তারা।
বিমান হামলার সংবাদ হুঙ্কার তুলে রেডিওতে।
মৃত্যুকে সে ঘৃণা করেছে, ঘৃণা করেছে জীবনকেও,
তাদের যখন হেঁটে যেতে হয়েছে এগিয়ে আসা মৃত্যুর দিকে,
আবৃত্তি করে তাদের ফিলিস্তিন-গাজা এর সমাপ্তিহীন মহাকাব্য।
অভিশাপ দিচ্ছি! কুখ্যাত ইসরায়েল তোমাকে। অভিশাপ দিচ্ছি, নালৎ পড়ুক ইসরায়েলের ওপর। তোমার স্তাবক, সমর্থকদের অভিশাপ দিচ্ছি। হে আরশের রব ফিলিস্তিনের জন্য আপনি ছাড়া আর কেউ রইল না এই পৃথিবীতে! আহ ফিলিস্তিন!! ফিলিস্তিনের শহর গাজা যেখানে বোমার সঙ্গে মানুষ উড়ে যাচ্ছে। ঝড়ো হাওয়ায় গাছের শুকনো পাতা যেভাবে আকাশে উড়ে যায়, বোমার আঘাতে পবিত্র ভূমির মানুষদের সেভাবে আকাশে উড়তে দেখল বিশ্ববাসী। একদিন আমাদের সকলকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। মহান রবের কাছে চাওয়া, মৃত্যুর আগে এই জুলুমের শেষ যেন দেখে যেতে পারি।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের এ যুদ্ধ কবে নাগাদ শেষ হবে তা কেবলমাত্র স্বয়ং উপরওয়ালা বলতে পারেন। কাজেই বাংলাদেশে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে প্রতিবাদস্বরূপ বিভিন্ন মহৎ কর্মসূচি চলতেই থাকবে।
পরিশেষে বলতে চাই, ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে জনমত গড়ে উঠছে, তা শান্তিপূর্ণভাবে অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা, বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এখন এছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।