Monday, March 17, 2025

সেকশন

English
Dhaka Tribune

বিশ্বে প্রয়োজন একটি জোটনিরপেক্ষ সংগঠন

বর্তমান বিশ্বে বৃহৎ শক্তির কাছে তৃতীয় বিশ্ব বন্দি হয়ে আছে

আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০১:৪৯ পিএম

মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার শাহাদাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ইসরায়েল-মিশর যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ থেকে চা, তাবুসহ বিভিন্ন দ্রব্যাদি যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিকদের জন্য প্রেরণ করেন। বন্ধুরাষ্ট্র মিশর সফরকালে কায়রো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার শাহাদাত।

পরবর্তীতে এই দুই নেতার মধ্যে বিশ্বের বৃহৎ দুই শক্তি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাহিরে থেকে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোকে কীভাবে আরও শক্তিশালী করা যায় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, জোট নিরপেক্ষ দেশগুলো সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা, নয়া-ঔপনিবেশিকতা, বর্ণবাদ এবং সমস্ত ধরনের বিদেশি আগ্রাসন, দখলদারিত্ব, আধিপত্য, হস্তক্ষেপ এবং সেইসঙ্গে বৃহৎ শক্তি এবং ব্লক রাজনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য গঠন করা হয়। ওয়ারশা প্যাক্ট ও ন্যাটোর বাইরে আরেকটি নিরপেক্ষ পথ অবলম্বন করাই ছিল এই সংগঠনের মুল লক্ষ্য।

একদিকে মার্কিনপন্থী পুঁজিবাদী দেশ অন্যদিকে সোভিয়েতপন্থী সমাজতান্ত্রিক জোট। এই দুই শক্তির বাহিরে গঠন করা হয়েছিল জোট নিরপেক্ষ সংগঠন। আজকের বাংলাদেশে হয়তোবা অনেকেই ভুলে থাকতে পারেন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের কথা। যেসব রাষ্ট্র ও নেতারা এই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তারা হলেন; যুগোস্লাভাকিয়ার মার্শাল জোসিপ ব্রোজ টিটো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু, মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসের, ঘানার প্রেসিডেন্ট ড. ফ্রান্সিস কোয়ামে নক্রুমাহ ও ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণো। পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার শাহাদাত, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিন,বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রাহমান ও কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো।

এরা সবাই এই জোটের নেতৃত্বে আসেন এবং বিশেষ ভুমিকা রাখেন। পরবর্তীতে মিশর সফরকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার শাহাদাতের জোট নিরপেক্ষ সংগঠন নিয়ে একান্ত আলোচনা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়। ১৯৭৪ সালে আনোয়ার শাহাদাত বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমানের কাছে ৩০টি যুদ্ধ ট্যাংক উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোরে খুনিরা বঙ্গবন্ধু হত্যায় এই মিশরীয় ট্যাংকগুলো ব্যবহার করে। সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্তে জোট নিরপেক্ষ জোটের বিশিষ্ট তিনজন নেতা; বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার শাহাদাতকে একে একে বুলেটের আঘাতে নিহত হতে হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে থেমে আসে জোট নিরপেক্ষ নিতির অগ্রযাত্রা।

বর্তমান বিশ্বে এখন প্রয়োজন আগের সেই জোট নিরপেক্ষ সংগঠন। কারণ, বিশ্ব ইতিহাস বার বার প্রমাণ করছে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলো তাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে বিশ্ব শান্তিতে করছে বাঁধার সৃষ্টি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আয়তনে ছোট হলেও এখন তারা বৃহৎ আকার সৃষ্টির জন্য একে একে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করছে। বৃহৎ শক্তিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কৌশল ঠেকাতে গিয়ে তৃতীয় বিশ্বের কোনো কোনো দেশকে দেউলিয়া পর্যন্ত হতে দেখা যায়। তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাদের এজেন্টদের দ্বারা আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সৃষ্টি করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। পরবর্তীতে দেশগুলোকে একটি চাপের মধ্যে রেখে তাদের স্বার্থ আদায় করে নেয়। বর্তমান বিশ্বে বৃহৎ শক্তির কাছে তৃতীয় বিশ্ব বন্দি হয়ে আছে।

ক্ষমতাধর এই দেশগুলো গণতন্ত্রের ধুয়ো তুলে তৃতীয় বিশ্বের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় এবং প্রয়োজনে সরাসরি হুমকি ও হস্তক্ষেপ করার মতো ক্ষমতা দেখায়। ভিসানীতি’সহ বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। সম্প্রতি বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের সরাসরি হুমকি ও পরোক্ষভাবে হতক্ষেপ তারই জলন্ত প্রমান। অথচ দীর্ঘদিন থেকে বিশ্বের পেট্রো ডলার দেশগুলোতে তথাকথিত রাজতন্ত্র ও কড়া একনায়কতন্ত্র থাকা সত্ত্বেও সেখানে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে গণতন্ত্র ও মানবধিকারের প্রশ্নে তারা নীরব। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে এসব বৃহৎশক্তি যার যার স্বার্থ রক্ষার্থে এখন দুই মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। চলছে তাদের শক্তির মহড়া। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা এ ধরনের শক্তির মহড়া দেখেছি।

এদিকে বিশ্ব রাজনীতিতে জোট নিরপেক্ষ ঐক্য পুঃনপ্রতিষ্ঠা না হলেও অনেকটা একই ধাঁচে এখন ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা মিলে প্রতিষ্ঠা করেছে ব্রিকস। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় এই সংগঠনের গোড়াপত্তন হয়। ব্রিকস নামটি দেওয়া হয়েছে উপরোক্ত এই পাঁচটি দেশের নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে। এই জোটে রাশিয়া, চীন, ভারতের মতো শক্তিশালী দেশগুলো একত্রিত হওয়ায় অনেক দেশই এই জোটে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অনেকে মনে করছেন, সরাসরি না হলেও এই জোট মূলত যুক্তরাষ্ট্রে বিরুদ্ধে অবস্থানের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের ধনশালী কয়েকটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি মনোক্ষুণ্ণ হয়ে ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য উৎসাহিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নগ্ন হামলা এই আগ্রহতা আরও দৃঢ় করেছে। ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের পক্ষে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের বন্ধুদেশগুলো সরাসরি সমর্থন দিয়েছে। এখন পেট্রো ডলারের দেশগুলো যদি সত্যি সত্যি ব্রিকসের সদস্য পদ লাভ করে তাহলে  যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের বন্ধু রাষ্ট্রদের জন্য হবে এ এক বিরাট অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাজয়। ভবিষ্যতে ব্রিকস শক্তভাবে টিকে থাকলে সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্ব রাজনীতিতে ভারসাম্য আনার জন্য বিভিন্ন দেশ মিলে একটি জোট প্রতিষ্ঠা করা এখন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে ইউরোপ-আমেরিকা ও তাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর আসল রসদ কিন্তু আসছে তৃতীয় বিশ্ব থেকেই। বাস্তবতা হলো, তৃতীয় বিশ্বের ওপরই তাদের অর্থনীতি পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। সুতরাং, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো মিলে একটি জোট গঠন হলে অথবা ব্রিকস যদি শক্তভাবে দাঁড়াতে সক্ষম হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধু রাষ্ট্রের মোকাবিলা করা খুব সহজ হবে বলে অনেকে ধারণা করছেন। ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও দখলদারীত্ব রুখতে হলে এর বিকল্প নেই। এই পরাশক্তিকে মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন এখন একটি জোটনিরপেক্ষ সংগঠন।

লেখক: ইলেক্টেড মেম্বার, সুইডিশ লেফট পার্টি, স্টকহল্ম ডিসট্রিক্ট ব্রাঞ্চ

প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত। ঢাকা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ এর জন্য দায়ী নয়।

 

   

About

Popular Links

x