Friday, April 18, 2025

সেকশন

English
Dhaka Tribune

বিশ্বাসীদের নেতা

ইসলামের মৌলিক শিক্ষার মধ্যে একটি হলো যে, আইনের শাসন এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা মান্য করা

আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:৫২ পিএম

প্রিয় তৌহিদি জনতা, গত কয়েক বছর জোরপূর্বক দমিয়ে রাখার পর অবশেষে আপনারা ফের দোর্দণ্ডপ্রতাপে জেগে উঠেছেন। আপনারা এখন দৃশ্যমান; আপনারা এখন শক্তিশালী। তবে আপনাদের কিছু কর্মকাণ্ডে আমরা ভীত, সন্ত্রস্ত এবং উদ্বিগ্ন। এই পরিস্থিতিতে আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই- আপনাদের শিক্ষক কারা? আপনারা কোন উম্মাহর অংশ?

আমি আপনাদের কাছে এই প্রশ্ন করছি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর দেখানো আদর্শ এবং তার দেওয়া শিক্ষার প্রেক্ষাপটে। কারণ, আপনাদের কিছু কর্মকাণ্ড দেখার পর মনে হচ্ছে; এটি আল্লাহর প্রেরিত মহাপুরুষ আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ এবং শিক্ষার সঙ্গে খুব কম সম্পর্কিত। অথবা, যে শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছেন; তার সঙ্গে আপনাদের কর্মকাণ্ড সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

প্রতিশোধ, হত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ

বছরের পর বছর ধরে নবিজি ও তার অনুসারীদের নির্মমভাবে নির্যাতন করেছিল কুরাইশরা। মক্কা বিজয়ের পর হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন (আর-রাহীকুল মাখতূম অনুযায়ী):

"হে কুরাইশ সম্প্রদায়, তোমাদের সঙ্গে আজ আমি কেমন আচরণ করব বলে মনে করো?"

তারা উত্তর দিলো "হে সম্মানিত ভাই এবং সম্মানিত ভাইয়ের পুত্র, আমরা আপনার কাছ থেকে শুধু কল্যাণের প্রত্যাশা করি।"

তাদের এ কথা শুনে প্রিয় নবি বললেন: “আমি তোমাদের সেকথাই বলছি, যেকথা ইউসুফ তার ভাইদের বলেছিলেন; তোমাদের প্রতি আজ আর কোনো অভিযোগ নেই। যাও তোমরা সবাই মুক্ত।”

যদিও আজকের দিনে বাংলাদেশে এমন একটি সাধারণ ক্ষমা বাস্তবসম্মত বা প্রত্যাশিত নাও হতে পারে, তবুও মহানবি (সা.) এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছু শিক্ষা অবশ্যই নেওয়া উচিত। নির্যাতনকারীদের অধিকার ও সম্পদের প্রতি মহানবি (সা.) কেমন আচরণ করেছেন অন্তত সেটা অনুকরণীয় হতে পারে। প্রথমত, মহানবি (সা.) বিজয়ের পর নির্যাতনকারী কাউকে গৃহহীন করা হয়নি, কারও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়নি। “আল্লাহু আকবর” বলে কারো বাড়িঘর ভাঙা হয়নি বা উসকানি দেওয়া হয়নি। উপরন্তু; আর-রাহীকুল মাখতূম-এ উল্লেখ আছে, মক্কা বিজয়ের পর মুসলমানদের মধ্যে কিছু মানুষ প্রতিশোধপরায়ণ আচরণ করলে মহানবি (সা.) অসন্তুষ্ট হন এবং “জাহেলি যুগের মতো প্রতিশোধ” থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। এমনকি প্রতিশোধমূলক হত্যার শিকার পরিবারগুলোর জন্য বিচারপ্রাপ্তির অধিকারও রেখেছিলেন মহানবি (সা.)।

মিশকাতুল মাসাবিহ হাদিস সংকলনের জিহাদ সংক্রান্ত অধ্যায়-১৯ এ একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যেখানে মহানবি (সা.) খালিদ বিন ওয়ালিদকে একটি বিদ্বেষী গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য পাঠান। কিন্তু খালিদ বিন ওয়ালিদ সেখানে গিয়ে ওই গোত্রের কয়েকজন হত্যা করেন এবং কয়েকজনকে বন্দি করেন। হাদিসের বর্ণনায় বলা হয়েছে:

"তিনি আমাদের প্রত্যেকের কাছে এক বন্দিকে হস্তান্তর করলেন। কিন্তু যখন একদিন খালিদ আমাদের সবাইকে বন্দিদের হত্যা করতে বললেন, আমি বললাম, 'আল্লাহর কসম, আমি আমার বন্দিকে হত্যা করব না এবং আমার কোনো সঙ্গীও তার বন্দিকে হত্যা করবে না, যতক্ষণ না আমরা মহানবির (সা.) কাছে পৌঁছায়।' যখন আমরা এই বিষয়টি মহানবির (সা.) কাছে উপস্থাপন করলাম, তখন তিনি দু’হাত উঠিয়ে দু’বার বললেন, ‘হে আল্লাহ, খালিদের এই কাজের জন্য আমি দায়ী নই’।”

মহানবি (সা.) হিংস্রতা ও প্রতিশোধের পথকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর-রাহীকুল মাখতূমে উল্লেখ আছে, এমনকি যখন তিনি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং প্রতিশোধ নেওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল; তখনও তিনি ওয়াহশিকে ক্ষমা করেছিলেন—যে তার প্রিয় চাচা হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে হত্যা করেছিল। তিনি সেই ব্যক্তিকেও ক্ষমা করেন, যার আঘাতে তার কন্যা আহত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে যার ফলে তিনি মারা যান।

হিংসা ও ক্রোধ

আমরা প্রায়ই "বিক্ষুব্ধ" শব্দটি শুনি, এবং এ বিষয়ে অনেক ছাড় দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু "ক্ষোভ" মূলত ক্রোধের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন যে; মুত্তাকিরা অর্থাৎ যারা আল্লাহর কথা মেনে চলে, তারা যেন তাদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে:

“যারা স্বচ্ছল ও সংকটময় অবস্থায় আল্লাহর পথে ব্যয় করে, যারা নিজেদের ক্রোধ দমন করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে—নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।” (সূরা আল ইমরান, ৩:১৩৪)

হাদিসেও কুরআনের এই নির্দেশনার ব্যাখ্যা রয়েছে। ইমাম বুখারি (রহ.) সংকলিত "আল-আদাব" (শিষ্টাচার) শিরোনামের ৭৮তম বইয়ের হাদিস ১৭৩-এ আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন:

“একজন ব্যক্তি নবি (সা.)-কে বললেন, আমাকে উপদেশ দিন!"

নবি (সা.) বললেন, "রাগ করো না।"

লোকটি বারবার একই অনুরোধ করলে, প্রতিবারই নবি (সা.) বললেন, "রাগ করো না।"

আরেকটি হাদিসে মহানবি (সা.) বলেছেন:

"শক্তিশালী ব্যক্তি সে নয়; যে কুস্তিতে কাউকে পরাস্ত করতে পারে, বরং প্রকৃত শক্তিশালী সেই ব্যক্তি; যে রাগের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে।”

রাষ্ট্রের আইন

ইসলামের মৌলিক শিক্ষার মধ্যে একটি হলো যে, আইনের শাসন এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা মান্য করা। তবে কিছু তৌহিদি জনতা মনে করেন যে, মানুষের তৈরি আইন এর অন্তর্ভুক্ত নয়। তাদের মতে, শুধুমাত্র ঐশ্বরিক আইন অর্থাৎ শরিয়াহ আইন পালন করা উচিত। এটি শরিয়াহ সম্পর্কিত আইন, আইনি বাধ্যবাধকতা এবং সামাজিক চুক্তির প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞাতপ্রসূত ধারণা।

 

আসুন একটু ব্যাখ্যার দেওয়া চেষ্টা করি। শরিয়াহ মূলত ঐশ্বরিক আইন এবং ফকিহিদের তৈরি আইনের সমন্বয়ে গঠিত। ঐশ্বরিক আইন হলো সেই বিধান; যা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, অর্থাৎ কুরআন। যেসব হাদিস প্রামাণিক হিসেবে বিবেচিত, সেগুলোকেও অনেক সময় ঐশ্বরিক আইন হিসেবে ধরা হয়; যদিও সব মতবাদের লোকেরা এটির সঙ্গে একমত নয়।

অন্যদিকে, ফকিহি আইন হলো পণ্ডিত এবং আইনজ্ঞদের (কখনো কখনো একজনের) সম্মিলিত জ্ঞানের সম্মিলন। শরিয়াহর অনেকাংশই ফকিহি আইন থেকে এসেছে। যেমন; কর, আর্থিক আইন, অপরাধমূলক ক্ষতি, অগ্নিসংযোগ, ভয়ভীতি, আক্রমণ, জমির বিধান, প্রাপ্তবয়স্ক এবং অপ্রাপ্তবয়স্কের বয়স, এবং অন্যান্য দৈনন্দিন প্রশাসনিক বিষয় যেগুলো ইজমা এবং কিয়াস থেকে এসেছে; এগুলো মানুষের তৈরি আইন। অর্থাৎ, মানুষের তৈরি আইনও সামাজিক চুক্তিতে ভূমিকা রাখে।

একটি দেশে বাস করা, নাগরিকত্ব, পাসপোর্ট, সড়ক, নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ, সীমানা, পরিবহন এবং প্রতিনিধিত্ব—এগুলো সবই একটি বাধ্যবাধকতা বা শপথ গ্রহণের মধ্যে পড়ে। যে শপথের মাধ্যমে একটি দেশের সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে তার আইন মেনে চলতে হয় এবং দেশের জনগণের কল্যাণের প্রতি ক্ষতিকর প্রভাব ঠেকাতে হয়। এটি মূলত সামাজিক চুক্তি, এমনকি ইসলামি প্রেক্ষাপট এবং কুরআন-হাদিসেও এসব চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

সূরা মায়িদাহ (৫:১) তাগিদ দিয়ে বলছে:

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার পূরণ করো।”

সূরা নাহল (১৬:৯১) বলছে:

“তোমরা যখন আল্লাহর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হও, তখন তা পূরণ করো এবং প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর তা ভঙ্গ কোরো না, যখন তোমরা আল্লাহকে তোমাদের ওপর সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করেছ।”

এ বিষয়ে আরেকটি ব্যাখা (সেকেন্ডারি লেজিসলেশন) পাওয়া যায় সহিহ বুখারি হাদিস ৩৪-এ, যেখানে বলা হয়েছে:

“আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন:

“চারটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, কারো মধ্যে এগুলোর সব থাকলে সে সম্পূর্ণ মুনাফিক; এবং কারো মধ্যে এর যেকোনো একটি থাকলে, সেটি সে পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য থাকবে। এই বৈশিষ্ট্য গুলো হলো- যখন সে কথা বলে, তখন মিথ্যা বলে; যখন প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন তা ভঙ্গ করে; যখন কোনো আমানত রাখা হয়, তখন সে বিশ্বাসঘাতকতা করে; যখন সে তর্কে লিপ্ত হয়, তখন অশোভন ভাষা ব্যবহার করে।”

অর্থাৎ, একজন মুসলমানের জন্য প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা তার ধর্মীয় দায়িত্ব, এবং নাগরিকত্ব নিজেই একটি প্রতিশ্রুতি। জননিরাপত্তা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক অধিকার, ব্যক্তি ও সম্পত্তির সুরক্ষা—এমনকি ট্রাফিক আইনের মতো নিয়মও হককুল ইবাদ-এর (মানবাধিকারের) অন্তর্ভুক্ত। এগুলো সমাজে মানুষের নৈতিক ও আইনি অধিকার এবং কর্তব্যের অংশ।

ভূখণ্ডে কর্তৃত্বের ব্যাপারে, সূরা আন-নিসা (৪:৫৯) বলছে:

“আল্লাহর আনুগত্য করো, রাসুলের আনুগত্য করো, এবং তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বপ্রাপ্ত, তাদেরও আনুগত্য করো।”

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এবং সরকারের কিছু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ইসলামী ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে আমার ধারণার চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞাত বলে মনে করি। এমনকি ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বেও একজন ইসলামি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যার দায়িত্ব হলো এই বিষয়গুলো পরিচালনা করা— সঠিক শিক্ষা ও নির্দেশনা দেওয়া।

কিন্তু যখন মাহফুজ আলম সমাজের একাংশকে "তৌহিদি জনতা" বলে সম্বোধন করলেন, তখন তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন না—"তোমরা কোন পথ অনুসরণ করছ?"  কেন তিনি বলেননি যে, কুরআন রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য করতে বলে? কেন কর্তৃপক্ষও স্পষ্ট করে বলছে না যে, তৌহিদি জনতা তাদের নিজেদের বিশ্বাসের বিরোধিতা করছে?

আরও স্পষ্ট করে বললে, তৌহিদি জনতা নিজেরাই কি ইসলামী মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করছে না? তাদের এই শিক্ষা কে দিয়েছে যে- দেশের আইন লঙ্ঘন করতে করতে হয় এবং ইসলামের আদর্শ উপেক্ষা করতে করতে "তাকবির" ধ্বনি দিতে হয়? কে তাদের “ইনকিলাবের আদব” শেখাচ্ছে?

তৌহিদি জনতা, আমি কি সত্যিই আপনাদের তৌহিদি হিসেবে বিবেচনা করব, যখন আপনাদের কর্মকাণ্ড ইসলামের আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়?

জিসান খান, সাংবাদিক ও আইনজীবী
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত। ঢাকা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ এর জন্য দায়ী নয়।
   

About

Popular Links

x