Saturday, April 26, 2025

সেকশন

English
Dhaka Tribune

সিপিআর জানা থাকলে বাঁচানো যেতে পারে অনেক জীবন

  • সিপিআর বিশ্বজুড়ে বহুল প্রচলিত জরুরি চিকিৎসা পদ্ধতি
  • কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের সময় সিপিআর জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে
আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২৫, ০৫:২৫ পিএম

হার্ট অ্যাটাকে আকস্মিক মৃত্যুর খবর আশপাশে প্রায়ই শোনা যায়। হঠাৎ হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়াকে বলা হয় হার্ট অ্যাটাক। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, মানসিক চাপসহ নানা কারণে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।

সম্প্রতি খেলার মাঠে অসুস্থ হয়ে পড়েন বাংলাদেশ জাতীয় দলের তারকা ক্রিকেটার তামিম ইকবাল। এরপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা জানান, হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল তামিমের। এরপর এনজিওগ্রাম, এনজিওপ্লাস্টি ও স্টেন্ট (রিং) পরানো হয় তামিমের।

এরকমভাবে জ্ঞান হারানোর পর মৃত্যুর ঘটনা অহরহই ঘটে। হঠাৎ এরকম অসুস্থ হয়ে পড়ার সময় থেকে হাসপাতালে পৌঁছানো এই সময়টা যেকোনো ব্যক্তির জীবন বাঁচানোর ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে একটা জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতি জানা থাকলে তা হয়ে উঠতে পারে আশীর্বাদ। এটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন বা সংক্ষেপে সিপিআর।

কেউ অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারালে, তার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলে বা শ্বাস প্রশ্বাস চালু না থাকলে সিপিআর দিতে হয়। এর মাধ্যমে ঐ ব্যক্তির ফুসফুসে অক্সিজেন দেওয়া হয়, একইসঙ্গে শরীরে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সঞ্চালন করতে থাকে, ফলে বেঁচে যেতে পারে অনেক জীবন।

সিপিআর বিশ্ব জুড়ে বহুল প্রচলিত এক জরুরি চিকিৎসা পদ্ধতি। সহজ করে বললে, বিভিন্ন নাটক বা সিনেমায় অনেকেই দেখে থাকবেন যে কোনো অচেতন ব্যক্তির বুকের ওপর দুহাত রেখে বারবার চাপপ্রয়োগ করা হচ্ছে এবং তার মুখে শ্বাস দেওয়া হচ্ছে, যার ফলে ঐ ব্যক্তির জ্ঞান ফিরে আসছে। এটিকেই বলা হয় সিপিআর।

তবে সিপিআর দেওয়ার কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। নিয়ম না মেনে সিপিআর দিল ঘটতে পারে হিতে বিপরীত। তাই সঠিক সিপিআর দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সিপিআর দেওয়া যেতে পারে সেটি জানা জরুরি।

সাধারণত স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি বিশেষ বাহিনী এবং সংস্থার সদস্যদের বাধ্যতামূলক সিপিআর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ মানুষদেরও তাদের নিজেদের স্বার্থেই সিপিআর প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা উচিত।

বিশ্বের অনেক দেশেই সাধারণ মানুষকে ছোটবেলা থেকেই সিপিআর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশে এ বিষয়ে সচেতনতা খুবই কম।

সিপিআর যখন দিতে হবে

হৃদরোগে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই অনেক ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু হয়। সেক্ষেত্রে সিপিআর জানা থাকলে তা জীবন বাঁচাতে রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, “আপনার সামনে যদি কারো কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়, তাহলে দ্রুত জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে (বাংলাদেশে ৯৯৯) ফোন করুন এবং সিপিআর দেওয়া শুরু করুন।”

একই কথা বলছে যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। সংস্থাটি বলছে, “যদি কেউ অজ্ঞান হয়ে যায় এবং স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস না নেয় তাহলে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে (বাংলাদেশে ৯৯৯) ফোন করতে হবে এবং সিপিআর দেওয়া শুরু করতে হবে।”

আমেরিকান রেড ক্রসের ভাষ্য অনুযায়ী, কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের সময় সিপিআর জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে থাকে। যখন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয় অথবা হার্টবিট নিয়মিত না হয়, তখন মস্তিষ্কে ও অন্যান্য জরুরি প্রত্যঙ্গে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক থাকে না। ফলে তা মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব ফেলে, যার কারণে অনেক সময় ব্যক্তি মারাও যেতে পারে। তবে এই সময় সিপিআর দিলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

চিকিৎসকরা বলছেন, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কার্ডিয়াক রোগীর হতে পারে, আবার কাযাদের কোনো হৃদরোগ নেই তাদেরও হতে পারে। এক্ষেত্রে কেউ জোরে আঘাত পেলে বা পড়ে গেলে, যদি দেখা যায় যে তার হার্ট বন্ধ হয়ে আসছে, তিনি মাটিতে শুয়ে পড়ছেন তখন সিপিআর শুরু করলে তাকে বাঁচানোর সময় পাওয়া যায়।

এরকম পরিস্থিতি যেমন হৃদরোগ থেকে হতে পারে, তেমনি ইলেকট্রিক শক, জোরে আঘাত, পানিতে ডুবে, শরীরে বড় ধরনের ইনফেকশন থাকা, এমন নানা কারণেই হতে পারে। আর এমন সময় গুলোতেই জরুরি ভিত্তিতে সিপিআর দেওয়ার কথা বলছেন চিকিৎসকরা।

সিপিআরের সাতটি ধাপ

রেড ক্রস সিপিআরের সাতটি ধাপের কথা বলছে। যেখানে প্রথম ধাপেই নিরাপত্তার দিকটা দেখতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তির আশেপাশে আগুন বা পানির মতো কোনো বিপজ্জন কিছু আছে কি-না, তিনি রাস্তার মাঝখানে কি-না ইত্যাদি বিষয় দেখে নিতে হবে। প্রয়োজনে পিপিই বা পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।

দ্বিতীয় ধাপে দেখতে হবে ব্যক্তিটি কোনো সাড়া দেয় কি-না সেটি দেখতে হবে। এজন্য তাকে ধাক্কা দিয়ে জোরে জোরে ডাকতে হবে। একইসঙ্গে পরীক্ষা করে দেখে নিশ্চিত হতে হবে যে কোনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে না।

সিপিআর দেওয়ার কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে/বিবিসি

যদি ব্যক্তির কোনো সাড়া না পাওয়া না এবং সে যদি নিঃশ্বাস না নেয় বা তার পালস না থাকে অথবা যদি ঘড়ঘড় করে, তাহলে এই পর্যায়ে তৃতীয় ধাপে এসে সাহায্যের জন্য ডাকতে হবে ও ৯৯৯ নম্বরে (অথবা সে দেশে যেটা ইমার্জেন্সি বা জরুরি পরিষেবার নম্বর) কল করতে হবে।

এরপর চতুর্থ ধাপে হাঁটু গেড়ে ঐ ব্যক্তির পাশে বসতে হবে। এ সময় হাত কাঁধ বরাবর সামনে থাকবে, আর ঐ ব্যক্তিকে সমতল জায়গায় চিৎ করে শুইয়ে দিতে হবে।

পঞ্চম ধাপে এসে মূল সিপিআর শুরু। প্রথমে ঐ ব্যক্তির বুকের ওপর দুটো হাত প্রতিস্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে এক হাতের ওপর আরেক হাত রেখে দুই হাতের আঙুলগুলো ধরে তালু দিয়ে চাপ দিতে হবে।

খেয়াল রাখতে হবে যেন চাপটি অন্তত দুই ইঞ্চি গভীরে যায়। প্রতিবার চাপ দিয়ে ছেড়ে দিতে হবে যাতে বুক আবার আগের অবস্থানে চলে আসে। চাপ দেওয়ার গতি থাকবে মিনিটে ১০০ থেকে ১২০ বার। তবে টানা ৩০ বার এরকম চাপ দেওয়ার পর একটা বিরতি নিতে হবে।

এরপর আসবে ষষ্ঠ ধাপ অর্থাৎ মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস দেওয়া। এজন্য মাথা সোজা রেখে থুতনিতে চাপ দিয়ে উপরে ঠেলে দিতে হবে, এরপর মুখটা হাঁ করতে হবে। তারপর ঐ ব্যক্তির নাক ধরে একটা স্বাভাবিক দম নিয়ে তার মুখে পুরো মুখ চেপে শ্বাস দিতে হবে। এর স্থায়িত্ব হবে এক সেকেন্ড এবং খেয়াল রাখতে হবে যাতে বুকটা একটা ফুলে উঠে। এরপর পরবর্তী শ্বাস দেওয়ার আগে মুখ উঠিয়ে সেটি বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে যদি প্রথমবারে বুকের উঠানামা না হয়, তাহলে মাথাটা আবার নাড়িয়ে নিয়ে মুখটা খুলে দেখে নিতে হবে যে গলায় বা মুখের ভেতরে কিছু আটকে আছে কি-না, যা নিঃশ্বাসের ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছে।

সপ্তম ধাপে বলা হয়েছে আবারও এরকম ৩০বার বুকে চাপ দেওয়া চালিয়ে যেতে হবে। আবার মুখে দুবার নিঃশ্বাস দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বুকে চাপ দেওয়ার বিরতি যেন ১০ সেকেন্ডের বেশি না হয়। এভাবে অ্যাম্বুলেন্স বা কোনো সাহায্য না আসা পর্যন্ত সিপিআর চালিয়ে যেতে হবে।

শিশুদের সিপিআর

অনেক সময় ছোট বাচ্চাদেরও সিপিআর দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। সেটা অবশ্য তাদের হৃদরোগের সমস্যার চেয়ে বেশি দেখা যায় যখন নিঃশ্বাসে কোনো সমস্যা হয়। তবে শিশুদের সিপিআরের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা মেনে চলার কথা বলছে যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা সংস্থা।

শিশুদের ক্ষেত্রে প্রথমেই এক হাত কপালে রেখে মাথাটা পেছনের দিকে নিয়ে থুতনিটা উঁচু করতে হবে। মুখ বা নাকে কোনো কিছু আটকে থাকলে সেটা সরিয়ে দিতে হবে। এরপর নাক ধরে মুখ থেকে মুখে পাঁচবার নিঃশ্বাস দিতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে বুকের উঠানামার দিকে।

শিশুদের সিপিআর দেওয়ার নিয়ম কিছুটা আলাদা/বিবিসি

এরপর এক হাতের তালু শিশুটির বুকের উপর বসাতে হবে এবং ৫ সেন্টিমিটার (প্রায় দুই ইঞ্চি) পর্যন্ত চাপ দিতে হবে। এই গভীরতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যদি এক হাতে সেটা সম্ভব না হয় তাহলে দুই হাতের তালু ব্যবহার করা যেতে পারে। আর এক বছরের নিচের শিশুর ক্ষেত্রে দুই হাতের বদলে দুটি আঙুল ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে চাপের গভীরতা হবে ৪ সেন্টিমিটার বা দেড় ইঞ্চি।

একইভাবে বড়দের মতোই মিনিটে ১০০ থেকে ১২০ বার চাপ ওদেয়ার গতিতে, ৩০ বার পরপর দুবার করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস দিতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রেও অ্যাম্বুলেন্স বা কোনো সাহায্য না আসা পর্যন্ত এভাবে সিপিআর চালিয়ে যেতে হবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা অবলম্বনে

   

About

Popular Links

x