পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে জুয়া খেলা বহু পুরনো এবং প্রচলিত একপ্রকার অবসর-বিনোদনের মাধ্যম। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে নতুন আতঙ্কের নাম অনলাইন জুয়া। আর এতে তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বেশি থাকলেও পিছিয়ে নেই বয়স্করাও। শুধু অনলাইন নয়,আজকাল অন্যান্য মাধ্যমেও জুয়া খেলে স্বর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকে। তবে, প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের সঙ্গে জুয়ার অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে অনলাইনে জুয়াতেই মানুষের অংশগ্রহণ বেশি।
এক ধরনের কৌতূহল থেকে তরুণ প্রজন্ম আকৃষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন জুয়ার সাইটে। প্রথমে অল্প টাকা বিনিয়োগে করে লোভে পড়ে একপর্যায়ে খোয়াচ্ছে লাখ লাখ টাকা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, বিদেশ থেকে পরিচালিত এসব সাইট বাংলাদেশেও পরিচালনা করছে তাদের এজেন্টরা। জুয়ায় বিনিয়োগ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে।
তবে, জুয়ার মাধ্যমে যে শুধু দেশের কিংবা ব্যক্তির অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে ব্যাপরটা তা নয়। জুয়ায় আসক্তির কারণে অনেকেই পারিবারিক অশান্তিতে ভুগছেন।
আর আশঙ্কাজনক তথ্য হলো, মানুষ শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে জুয়ায় আসক্ত হয় না। এটি এক ধরনের মানসিক রোগও।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে,জুয়ার নেশা যখন জুয়াড়িদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং দৈনন্দিন জীবনে নিরানন্দের কারণ হয়ে ওঠে তখন তা গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়।
ভারতের নিমহান্স হাসপাতালের এক গবেষণা বলছে, জুয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ৮৭.৫% সমস্যা একজন জুয়াড়ির জীবনে ২৫ বছর বয়সের আগেই শুরু হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুয়া খেলতে খেলতে অনেক মানুষই নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং এই আচরণের জন্যই তাদের গোটা জীবনটা সমস্যায় ভরে যায়। জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে তারা শুধু জুয়া খেলার সুযোগ খোঁজে এবং জুয়ার মধ্যেই নিজেদের জীবনকে ডুবিয়ে রাখে। অনেকে টাকাপয়সা খুইয়ে এবং নানা বিপত্তি সত্ত্বেও জুয়া খেলা ছাড়তে পারে না। বহুবার জুয়ার নেশা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেও অনেকে শেষ পর্যন্ত জুয়া খেলা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে না। এটা অনেকটা মাদকের আসক্তির মতো।
মানসিক অসুস্থতার বিভিন্ন ভাগ বা পর্যায় অনুযায়ী, যেমন- ডিএসএম-৫ (ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল ডিসঅর্ডার) এবং আইসিডি-১০ (ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অফ ডিজিজ) অনুযায়ী জুয়া খেলার তাড়নাকে একপ্রকার আসক্তি বলেই বিবেচনা করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, অন্যান্য আসক্তির সমস্যার মতোই জুয়ার প্রতি নেশার পিছনে রয়েছে জিনগত, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং জৈবিক বা বায়োলজিকাল কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মস্তিষ্কের একটি বিশেষ কার্যাবলী (রিওয়ার্ড পাথওয়ে)। এর ফলে আমরা যে কাজই করি না কেন তা করতে আমাদের খুবই ভালো লাগে এবং এর মধ্য দিয়ে নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে যে ডোপামিন নিঃসরণ হয় তা আমাদের মধ্যে একধরনের সন্তুষ্টির জন্ম দেয়। যে কোনো আসক্তির ক্ষেত্রে তা সে মাদকাসক্তি বা জুয়ার প্রতি আসক্তি যাই হোক না কেন, সেখানে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স সক্রিয় হয়, যা আমাদের আবেগের তাড়নাকে অবদমিত করে, তাকে দুর্বল করে দেয়। গবেষকদের মতে, যেসব মানুষের মধ্যে জুয়ার নেশা রয়েছে তাদের মধ্যে রিওয়ার্ড অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে।
মানুষ যখন জুয়ার তাড়না থেকে নিজেকে কিছুতেই দূরে রাখতে পারে না, তখন সেটিকে মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই পর্যায়ে মানুষ জুয়ার জন্য যদি সে তার সর্বস্ব হারিয়ে ফেলে তাতেও সে কিছুতেই জুয়ার নেশা ত্যাগ করতে পারে না। আর এই নেশা যখন চরমে পৌঁছায় তখন তা মানুষের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, জুয়ার নেশার মতো মানসিক রোগ একনাগাড়ে অনেকদিন স্থায়ী হয় এবং বারবার ফিরে আসে। জুয়ার আসক্তির বা জুয়ার নেশা যখন মানসিক অসুখে পরিণত হয় তখন তার কয়েকটি লক্ষণ দেখা যায়। সেগুলো হলো-
জুয়া খেলা নিয়ে এদের মনে সবসময়ে একপ্রকার বদ্ধমূল ধারণা থাকে; যেমন- পূর্ববর্তী জুয়া খেলার অভিজ্ঞতা ভুলে এরা পরবর্তী খেলার পরিকল্পনা করে, টাকার ব্যবস্থা করে।
জুয়া এই জাতীয় মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্র এবং কাজের জগতে ক্ষতি ডেকে আনে।
এরা জুয়া খেলে মূলত জীবনের ছোট-বড় সমস্যার মুখোমুখি হওয়া থেকে পালানোর জন্য অথবা মানসিক উদ্বেগ, অপরাধ বোধ, অসহায়তা, অবসাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য।
তারা জুয়া খেলার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে চেষ্টা করে কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা সফল হয় না।
তারা তাদের জুয়ার প্রতি আসক্তি অন্যান্যদের কাছ থেকে গোপন রাখতে চেষ্টা করে।
তারা জুয়া খেলার নেশায় নিজেদের এতটাই জড়িয়ে ফেলে যে জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলোকে অবহেলা করে।
তারা জুয়া খেলার জন্য অসৎ পথে টাকা রোজগার করা শুরু করে। এরা জুয়া খেলার জন্য অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার করে এবং ক্রমশই তারা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে। জুয়ার নেশার মতো এই ধরনের আসক্তিমূলক আচরণ করাই এই অবস্থায় অগ্রাধিকার পায়।
পারিবারিক ইতিহাস, ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপ, মাদকের প্রতি আসক্তি এবং বয়স- সবকিছুর ক্ষেত্রেই জুয়া খেলার প্রভাব পড়তে পারে। অন্যান্য আসক্তিগত সমস্যার মতো জুয়ার আসক্তিও পুরুষদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়।
জুয়ার নেশাজনিত মানসিক রোগের সমস্যা সাধারণত বহুদিন ধরে স্থায়ী হয় এবং যদি এর সঠিক চিকিৎসা না হয় তাহলে অন্যান্য আরও অনেক জটিলতা বেড়ে যেতে পারে। সেই সমস্যাগুলো হলো-
- মাদকের প্রতি আসক্তি
- ব্যক্তিগত, পেশাগত এবং অর্থনৈতিক সমস্যা যেমন- সর্বস্বান্ত বা দেউলিয়া হয়ে যাওয়া
- জুয়া খেলার উত্তেজনায় মানুষ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হতে পারে
- উদ্বেগজনিত সমস্যা
- আত্মহত্যার প্রবণতা
জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তির সুস্থতার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞর শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। এছাড়া, এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
যদি কেউ দেখেন যে তার কাছের মানুষ জুয়া খেলার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে তাহলে প্রথমে তার সমস্যাটা ভালো করে বুঝতে হবে এবং এই নেশা থেকে তাকে দূরে সরাতে উৎসাহ দিতে হবে। সঠিক সময়ে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করতে হবে এবং অতীতের কথা আলোচনা করা চলবে না। শুধুমাত্র বর্তমানের সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে ও জুয়া কীভাবে একজন মানুষের জীবনে বিপদ ডেকে আনছে সেই বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা জরুরি। এক্ষেত্রে জুয়ার নেশায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করা একেবারেই সঠিক কাজ নয়।
যদি তারা ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করাতে রাজি হয় তাহলে তার কাছের মানুষের উচিত তার পাশে থাকা এবং তার জন্য অনেক সময় ব্যয় করা। তবেই একজন মানুষকে সর্বনাশা নেশা থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা সফল হয়।
জুয়া খেলার মতো বদ অভ্যাস যে মানুষের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনতে পারে সেই বিষয়ে একজন জুয়াড়িকে সতর্ক করা প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়া এক একজনের ক্ষেত্রে এক একরকম হয়। যেমন- কাউকে জুয়াখানা বা ক্যাসিনোর বিজ্ঞাপন দেখিয়ে সতর্ক করা জরুরি, অথবা কারোর হাতে অনেক টাকা দিয়ে তাকে মনে করিয়ে দেওয়া উচিত যে এমন কাজ করা উচিত নয় যেখানে বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। আসলে বিপদ চেনানোর কাজে তাকে সাহায্য করা এবং সেই বিপদের মধ্যে যেন সে ঝাঁপ না দেয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি।