রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরের বেশিরভাগ সড়কের নামই মুঘল আমলের রাজা-বাদশার নামে। তবে এখনকার দুটি সড়কের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালিদের নাম। জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের গৌরবজ্জ্বল স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। যদিও সেই ইতিহাস অনেকেরই অজানা।
মোহাম্মদপুরের এই দুটি সড়ক হলো, আসাদ অ্যাভিনিউ ও শহিদ সলিম উল্লাহ সড়ক। আসাদ অ্যাভিনিউয়ের নামকরণের ইতিহাস অনেকেরই জানা থাকলেও বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন, সলিম উল্লাহ সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে ঢাকার নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর নামে।
তবে টাউনহল বাজারের পশ্চিম পাশে আসাদ অ্যাভিনিউ-তাজমহল রোডের সংযোগস্থলের এই সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে মূলত ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ শহিদ হওয়া একজন দেশপ্রেমিক বাঙালির নামে। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৯৭১ সালে নিরীহ শান্তিপ্রিয় বাঙালিদের ওপর চালানো এক নির্মম হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস।
মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের চারতলা একটি বাড়িতে স্ত্রী জেবুন্নেছা এবং ১০ সন্তান নিয়ে থাকতেন মহম্মদ সলিম উল্লাহ।
সলিম উল্লাহর জন্ম ১৯২৪ সালে চাঁদপুরের কচুয়ায়। তার বাবা হাছান আলী সরকার, মা ওমর জান। তারা তিন ভাই ও দুই বোন ছিলেন। পেশায় ব্যবসায়ী সলিম উল্লাহ সমাজসেবক হিসেবেও বেশ পরিচিত ছিলেন। ১৯৬১ সাল থেকে তিনি পরিবার নিয়ে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের সি-১২/১০ বাড়িটিতে বসবাস শুরু করেন।
সেই সময় মোহাম্মদপুর এলাকায় প্রচুর উর্দুভাষীদের বসবাস। তখন সেখানকার বাঙালি ও অবাঙালি সমন্বয় কমিটির প্রধান ছিলেন সলিম উল্লাহ। মোহাম্মদপুর থানার আওয়ামী লীগের সভাপতিও ছিলেন তিনি। তাই তার বাড়িতে রাজনৈতিক কর্মীদের বেশ যাতায়ত ছিল, বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখতেন না অবাঙালি বিহারি ও পাঞ্জাবিরা।
তারও আগেই অবাঙালিদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন সলিম উল্লাহ। ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে। সেই সময় মোহাম্মদপুরে বাংলা মিডিয়ামের কোনো আলাদা স্কুল ছিল না, তাই সলিম উল্লাহ চেয়েছিলেন মোহাম্মদপুর বয়েজ স্কুল যেন উর্দু মিডিয়াম না হয়ে বাংলা মিডিয়াম হয়। আর সেজন্য সেই সময় তিনি বেশ ছোটাছুটিও করেছিলেন। যে বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি সেখানকার অবাঙালিরা।
এরপর আসে ১৯৭১ সাল। দিনটি ছিল ২৩ মার্চ, পাকিস্তান দিবস। মোহাম্মদপুরের বেশিরভাগ অবাঙালি পরিবারে যখন পাকিস্তান দিবস পালনের মহাসমারোহ, সেদিন তাজমহল রোডের সলিম উল্লাহর চারতলা বাড়ির ছাদে ওড়ানো হয় বাংলাদেশের পতাকা।
সেজ ছেলে সাদি মহম্মদের আঁকা মানচিত্র সোনালি সুতোয় এম্ব্রডায়েরি করে কাপড়ে সেলাই করে পতাকা বানিয়ে দিয়েছিলেন সলিম উল্লাহর স্ত্রী জেবুন্নেছা।
তবে ছাদে পতাকা ওড়ানোর বিষয়টিকেও খুব একটা ভালো লাগেনি স্থানীয় অবাঙালি তথা পাকিস্তানিদের। সেদিনই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার সলিম উল্লাহর বাড়িকে রেকি করে। ঘুরপাক খেতে থাকে ছাদের ওপর থেকে।
এরপর ২৫ মার্চ রাতে সলিম উল্লাহর বাড়িতে বাঙালি-অবাঙালিদের নিয়ে সভা বসে। যে সভায় বঙ্গবন্ধুর “চার খলিফা” হিসেবে পরিচিতদের মধ্যে দুজন আবদুল কুদ্দুস মাখন ও নুরে আলম সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় ফের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ডাক দেন সলিম উল্লাহ। তবে শান্তিতে থাকতে পারেননি সলিম উল্লাহর পরিবার। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম ধ্বংসযজ্ঞের পর ২৬ মার্চ দিনের আলোতে সলিম উল্লাহর বাড়িতে নেমে আসে ভয়াবহ অন্ধকার।
যে ঘটনার বর্ণনা জীবদ্দশায় দিয়ে গেছেন শহিদ সলিম উল্লাহর সদ্যপ্রয়াত সেজ ছেলে দেশের খ্যাতনাম রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী সাদি মহম্মদ।
চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলের “স্বপ্নভূমি” প্রামাণ্যচিত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাদি মহম্মদ জানান, ২৬ মার্চ জুমার নামাজের সময় তারা ভাইবোনেরা বাড়িতে ছিলেন। তবে বাড়ির পাশের মসজিদে নামাজ পড়তে যান বাবা সলিম উল্লাহ। নামাজের শেষ পর্যায়ে তাদের বাড়ির পেছনে “ভুপাল কটেজ” নামের একটি বাড়ি থেকে দুটি ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। ওই বাড়িতে বসবাস করত একটি পাঞ্জাবি পরিবার। তবে সলিম উল্লাহর বাড়ি থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে এমন অভিযোগে মসজিদ থেকে বের হয়ে দলে দলে লোক হামলা করে সলিম উল্লাহর বাড়িতে। ততক্ষণে দ্রুত বাড়িতে চলে আসেন সলিম উল্লাহ্। আর ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে হামলা শুরুর পরই এই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল আশেপাশের অসংখ্য বাঙালি পরিবার। তাদের বিশ্বাস ছিল, সলিম উল্লাহ’র বাড়িটি নিরাপদ, এই বাড়িতে কেউ হামলা করবে না। কিন্তু মুহূর্তেই তাদের সেই বিশ্বাস ভেঙে যায়, বোমা-গুলি চালানো হয় বাড়িটিতে। ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন। বাড়িটিতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ২৫ জন মানুষ মারা যান বলে সাক্ষাৎকারে জানান সাদি মহম্মদ। বোমার স্প্লিন্টারে আহত হন সাদির মেজ ভাই।
প্রাণ বাঁচাতে একপর্যায়ে চারতলা বাড়ির দোতলা থেকে পাশের বাড়িতে লাফিয়ে পড়েন সলিম উল্লাহ’র পরিবারের সবাই। লাফিয়ে পড়ে পা ভেঙে যায় স্ত্রী জেবুন্নেছার। সাদির সবচেয়ে ছোট ছয় মাস বয়সী জমজ দুই বোন ছিল চাচার কোলে। বাকি ভাইবোনেরা সবাই যে যার মতো লুকিয়েছেন। সাদি পাশের বাসার একটি বাথরুমে লুকান। সেখানে গিয়ে দেখেন ভাঙা পা নিয়ে পড়ে আছেন মা, সঙ্গে বাবা সলিম উল্লাহ।
হঠাৎ এয়ারফোর্সে চাকরি করা সলিম উল্লাহর একজন অবাঙালি প্রতিবেশী ছুরি হাতে ঢোকেন সেখানে। আঘাত করেন সলিম উল্লাহর পিঠে। আহত বাবাকে বাঁচাতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন কিশোর সাদি মহম্মদ। হাত দিয়ে চেপে ধরেন বাবার ক্ষতস্থান। গলগল করে বেরোনো রক্তে ভেসে যেতে থাকে তার হাত। একপর্যায়ে বাবা সলিম উল্লাহ তাকে বলেন পালাতে। বাবা জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত বাইরে বের হয়ে আসেন সাদি। আশ্রয়ের জন্য ছুটে যান পাশের একটি বাড়িতে। সেখানে গিয়েও দেখেন লাশের স্তূপ। সেখান থেকে বাইরে বের হয়ে এসে দেখেন চাচা এবং এক খালাতো ভাইয়ের নির্মম মৃত্যু। চাচার কোলে থাকা ছয় মাস বয়সী দুই বোনকে ছুড়ে ফেলে বুক বল্লম বসিয়ে দেয় ঘাতকরা। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত গলায় রশি দিয়ে গাড়ির সঙ্গে বেঁধে ঘোরানো হয় রাস্তায়। একইভাবে গাড়ির সঙ্গে রশিতে বেঁধে মোহাম্মদপুর ইদগাহ মাঠে নিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয় সাদির এক খালাতো ভাইকে।
চোখের সামনে প্রিয়জনদের এই ভয়াবহ মৃত্যর এই নির্মম অভিজ্ঞতা আমৃত্যু বয়ে বেরিয়েছেন সাদি মহম্মদ। প্রচণ্ড পরিমাণ ঘৃণা পুষে রেখেছেন পাকিস্তানিদের প্রতি। তবে সেটা প্রকাশ করেননি। বরং স্বাধীন বাংলাদেশে মায়ের সঙ্গে মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পের অবাঙালিদের বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে আর্থিক সহযোগিতা করে গেছেন। করেছেন তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে মোহাম্মদপুর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রচেষ্টায় সাদি মহম্মদের বাবার প্রতি সম্মান জানিয়ে তাজমহল রোডসংলগ্ন সড়কটির নাম রাখা হয় “শহিদ সলিম উল্লাহ সড়ক”। পরে এটি সরকারিভাবে স্বীকৃতিও পায়।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, পাকিস্তান আমলে সড়কটি “কায়েদে আজম” রোড নামে পরিচিত ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এটি শহিদ সলিম উল্লাহর নামে পরিবর্তন করা হয়।
এদিকে, দেশ স্বাধীন হলে তাজমহল রোডের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি ফিরে পেতেও বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছে সাদি মহম্মদের পরিবারের। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও শেষ হয়নি জেবুন্নেছার জীবনযুদ্ধ। যুদ্ধের সময় সন্তানদের নিয়ে বসিলা এলাকায় নিজেদের আরেকটি বাড়িতে অবস্থান করেন জেবুন্নেছা। ভাঙা পা নিয়ে সে আরেক যুদ্ধ।
দেশ স্বাধীনের পর আসেন তাদের পুরোনো ঠিকানায়। পুড়ে যাওয়া বাড়িটির সংস্কারের কাজ শুরু করেন। তবে যুদ্ধের পর সলিম উল্লাহর বাড়িটিকে শত্রুর সম্পত্তি হিসেবে দেখানো হয়েছিল। তা নিয়ে পরবর্তী সময়ে মামলাও হয়। আদালতের রায়ে বাড়ির মালিকানা ফিরে পান শহিদ সলিম উল্লাহ্’র পরিবার।
সেলাইয়ের কাজ করে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ যোগান মা জেবুন্নেছা। সুশিক্ষিত করে তোলেন সন্তানদের। তাদের মধ্যে সেজ ছেলে সাদি মহম্মদ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চায় রেখেছেন অগ্রগণ্য ভূমিকা। আরেক ছেলে শিবলী মহম্মদ নৃত্যশিল্পে দেশের সর্বকালের সেরাদের তালিকায়।