বন্যায় সিলেট-তামাবিল-জাফলং মহাসড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। সোমবার থেকে অবিরাম ঝড়বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট জকিগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩০ মে) সকাল থেকে জৈন্তাপুর উপজেলার বাংলা বাজার, রংপানি ও বিলাইমারা এলাকায় সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের ওপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে এই চার উপজেলায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয়ের তথ্য মতে, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সিলেটের কানাইঘাট সুরমা পয়েন্টে বিপৎসীমার ১.৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জকিগঞ্জ উপজেলার অমলসিদে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ২.০২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিয়ানীবাজার উপজেলার শেওলায় কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ০.০৫ সেন্টিমিটার, জৈন্তাপুর উপজেলায় সারি নদীর পানি বিপৎসীমার ০.৯৫ সেন্টিমিটার ও গোয়াইনঘাটে সারি নদীর পানি বিপৎসীমার ০.৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
আকস্মিক বন্যায় আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার কাজে যোগ দিয়েছে সেনাবাহিনী, বিজিবি, জৈন্তাপুর মডেল থানা পুলিশ টিম, ফায়ারসার্ভিস, আনসার বিডিপি এবং বিভিন্ন ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি। ছাড়াও বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠন, সামাজিক, রাজনৈতিক দলের নেতারা।
বৃহস্পতিবার সকালে পানিবন্দি এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছেন সিলেট জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহফুজা আক্তার সিমুল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদ নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালিক রুমাইয়া সহকারী কমিশনার ভূমি ফাতেমা তুজ জোহরা সানিয়া, মডেল থানা অফিসার ইনচার্জ তাজুল ইসলাম।
বুধবার সন্ধ্যা থেকে সারি নদী ও জাফলংয়ে পিয়াইন নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট, জৈন্তাপুর, দরোবস্ত ও চারিকাটা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এই উপজেলায় ছয়টি ইউনিয়নে ৪৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ইতোমধ্যে কন্ট্রোল রুম চালু করেছে উপজেলা প্রশাসন।
জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) উম্মে শালিক রুমাইয়া বলেন, “সেনাবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ উদ্ধার কাজ করছে। আমি সার্বক্ষণিক বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। আমাদের চারিকাটা, নিজপাট ও জৈন্তাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ৪৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ প্রস্তুত রেখেছি। পাশাপাশি উপজেলার সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ পর্যন্ত কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আমাদের এই সংকটময় সময়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে সবার সম্মিলিত সহযোগিতায় এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।”
জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী বলেন, “উপজেলার টিলা এলাকা ছাড়া বাকি সব এলাকাই প্লাবিত হয়েছে। কোথাও কোথাও মানুষের বাড়ির ছাউনি পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। বুধবার রাতে অন্ধকার ও প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার অভিযানে সমস্যা হচ্ছিল। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে ব্যাপকভাবে উদ্ধার কাজ চলছে। মানুষ উদ্ধার করা গেলেও গৃহপালিত পশুপাখির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চাল বরাদ্দ থাকলেও রান্না করে খাওয়ার মতো শুকনো জায়গা নেই। আমরা বন্যা-কবলিত মানুষের জন্য আপাতত শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করছি।”
এদিকে, ধারাবাহিক বৃষ্টিপাতের কারণে সিলেটে সুরমা, কুশিয়ারা ও সারি নদীর পানি তিনটি পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ও পর্যটন কেন্দ্র পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্রসহ সব পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করেছে উপজেলা প্রশাসন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুনজিত কুমার চন্দ্র।
গোয়াইনঘাট উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে মোট ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা রয়েছে। অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও প্লাবন প্রবণ এলাকার জনগণকে দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। বুধবার সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়ক তলিয়ে যাওয়ার কারণে যান চলাচল বন্ধ হয়ে উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে জকিগঞ্জ উপজেলার বারহাল, সদর, খলাছড়া, কছকনাপুর ও কাজলশাহ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম বন্যার প্লাবিত হয়েছে। জকিগঞ্জ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সবুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বন্যার্তদের সহযোগিতায় একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে বলেও জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
জকিগঞ্জ উপজেলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আফসানা তাসনিম জানান, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ৫৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ২২টি পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেন, “বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের জন্য চাল ও শুকনো খাবার প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সেগুলো বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “বন্যায় উপজেলার ৭৫% এলাকা প্লাবিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। জাফলং-বিছনাকান্দিসহ সব পর্যটন এলাকার পর্যটকবাহী নৌকা নিয়ে উদ্ধার অভিযান চলছে। বন্যার পূর্বাভাস থাকায় আমরা আগেই ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করে রেখেছিলাম। কাল রাতেই ১৬৭টি পরিবার আশ্রয় নেয়, সকাল থেকে যা ২৫০ ছাড়িয়েছে।”
ইউএনও আরও জানান, বন্যা-কবলিত মানুষের জন্য আগের বরাদ্দ ৪৮ টন চালের সঙ্গে নতুন ১৫ টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এছাড়াও, ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বন্যা কবলিতদের ত্রাণ বিতরণ করা হবে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসাইন বলেন, “বন্যা পরিস্থিতি গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি খারাপ। স্থানীয়দের সহযোগিতায় উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে উপজেলা প্রশাসন। সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। প্রয়োজনে তারাও উদ্ধার অভিযানে যোগ দেবে।”
তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে জেলা ও উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক হয়েছে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কন্ট্রোল-রুম খোলা হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে।”
বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচটি উপজেলায় ২০০ বস্তা করে ১,০০০ বস্তা শুকনো খাবার, ১৫ মেট্রিক টন করে ৭৫ মেট্রিক টন চাল, প্রত্যেক উপজেলায় ৫০ হাজার টাকা করে আড়াই লাখ টাকার ত্রাণ সামগ্রী দেওয়া হয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মোহাম্মদ সজিব হোসেন বলেন, “আগামী তিন দিন সিলেটে অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে “
এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, “পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টির কারণে সিলেটের গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিচ্ছে। বন্যাদুর্গত এলাকাগুলো পরিদর্শন করছি। তাছাড়া তাদের খাবারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।”
অপর এক প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। প্রয়োজন হলে তারা কাজ শুরু করবে।”