২০০০ সালে বিশ্ব সাক্ষী হয় বেশকিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার। ওই বছর বিশ্বনেতারা সম্মিলিতভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রণয়ন এবং সেটির বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। যা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) হিসেবে পরিচিত পায়। এতে দারিদ্র্য হ্রাস, রোগ-ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই, শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতকরণসহ আটটি বিষয় নির্দিষ্ট করা হয়।
এগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২০১৫ সালকে।
আটটি মূল লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ২১টি বিশেষ বিষয়ে উন্নতির দিকে নজর দেওয়া হয়। সে লক্ষ্যে উল্লিখিত দেড় দশকে বিভিন্ন দেশের সরকার, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো আগের চেয়ে বেশি অর্থের বরাদ্দ দেয়। ওই সময়ে বৈশ্বিক উন্নয়ন সহায়তা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়। শিশুস্বাস্থ্য খাতে বিশ্বব্যাপী বার্ষিক তহবিল ১৯৯০ এর তুলনায় ৮ গুণ বেড়ে ২০১৫ সালে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়৷ যদিও আমরা সমস্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারিনি, তবে এই বিশাল বিনিয়োগ সামগ্রিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এই সময়ে স্কুলগামী শিশুদের সংখ্যা বেড়েছে, লৈঙ্গিক সমতার উন্নতি হয়েছে। বিশ্বজুড়ে নিম্নআয়ের দেশগুলোতে শিশুমৃত্যুর হার আগের তুলনায় অনেক কমেছে। ১৯৯০ সালে বিশ্বে দশজনের মধ্যে প্রায় একজন শিশু পাঁচ বছর বয়সের আগেই আগেই মারা যেত। ২০১৫ সাল নাগাদ শিশুমৃত্যুর হার অর্ধেকেরও বেশি কমে গিয়েছিল। ফলে, বিশ্বে ১ কোটি নব্বই লাখ শিশুর প্রাণ বেঁচে যায়, যাদের পাঁচ বছর বয়সের আগেই মৃত্যুর ঝুঁকি ছিল। উল্লিখিত সময়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা নিরসনেও নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে।
১৯৯০ সালে বিশ্বে ১৬% মানুষ খাদ্যসঙ্কটে ভুগত। ২০১৫ সালে তা কমে ৮%-এ এসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ৩০ কোটি মানুষ ক্ষুধা এবং অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা পায়।
দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও আশ্চর্যজনকভাবে উন্নতি হয়েছিল এই সময়টাতে। ১৫ বছরে বিশ্বের ১.২ বিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি পায়।
বিশ্বের দরিদ্র এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য এমডিজি আশীর্বাদে পরিণত হয়। যদিও বিশুদ্ধ খাবার পানি এবং স্যানিটেশনের মতো কিছু বিষয়ে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সম্ভব হয়নি। তবে, জীবনযাত্রা সহজীকরণ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিরসন, দূষিত পানি হ্রাস, স্কুলগামী শিশুদের সংখ্যা বৃদ্ধি, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া এবং এইচআইভি রোগে মৃত্যুর হার কমানোর পাশাপাশি শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসে উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখেছে বিশ্ব।
কিন্তু ২০১৫ সালে বিশ্বনেতারা এমডিজি থেকে সরে এলে এই খাতগুলো বড় ধাক্কার মুখে পড়ে। বিশ্বনেতারা আবার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যেমাত্রা অর্জনে জোর দিতে পারতেন। কিংবা একই লক্ষ্যমাত্রায় আরও কিছুদিন স্থির থাকতে পারতেন। কারণ, বিশ্বের দরিদ্র এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য তারা ভরসাস্থল। এসব মানুষের প্রয়োজন বিবেচনায় নিয়ে কিছু বিষয়ে জোর দেওয়া যেত।
পরিবর্তে, জাতিসংঘের সমন্বয়ে তারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) হিসেবে ২০১৫-২০৩০ সাল পর্যন্ত ১৬৯টি লক্ষ্য অর্জনের একটি অযৌক্তিক দীর্ঘ তালিকা প্রণয়ন করেন।
এসিডিজিতে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিরসন, রোগমুক্তি, যুদ্ধের অবসান এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসের মতো বেশকিছু বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। তারা সবুজায়নের মতো কিছু দূরবর্তী লক্ষ্যমাত্রাও সংযুক্ত করেছেন। ১৬৯টি লক্ষ্যের অর্থ বিশেষ কোনো বিষয়ে অগ্রাধিকার না থাকার মতোই। আর এর অনিবার্য পরিণতি হলো- আমরা গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নমূলক পদক্ষেপে পিছিয়ে পড়ছি।
ইতোমধ্যে আমরা এসডিজির অর্ধেক সময় পার করে ফেলেছি। কোভিড মহামারি পূর্ব ও পরবর্তী অগ্রগতি মিলিয়ে যে অবস্থা তাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এই শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লেগে যাবে।
তবে ভালো ব্যাপার হলো অন্যান্য দেশের তুলনায় এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি বেশ ভালো। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা থেকে এখনও অনেক পিছিয়ে। ২০১৫-২০১৯ সালের ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০৪৮ সালের দিকে তার এসডিজি সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছে।
এই অবস্থা ইতিহাসে আমাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ প্রজন্ম হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। কোন বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে, সেটি চূড়ান্ত না করারই ফল। তাহলে কীভাবে আমরা এখান থেকে কোনো বিষয় নির্দিষ্ট করব?
প্রথমত, যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকেই আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এখনও বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের কাছে রিসাইকেলিং কিংবা জলবায়ু বিষয়ক উন্নয়নের চেয়ে সুন্দর জীবনযাপনের জন্য খাদ্যের নিশ্চয়তা ও শিক্ষার সুযোগ (১৬৯টি লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম) নিশ্চিত করা বেশি জরুরি।
দ্বিতীয়ত, আমাদের স্বীকার করতে হবে, কিছু চ্যালেঞ্জ সহজে বাস্তবায়নযোগ্য নয়। শান্তি প্রতিষ্ঠা, সহিংসতা, অপরাধ এবং দুর্নীতি রোধ প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এগুলো বাস্তবায়নের পথ বেশ কঠিন। কীভাবে এসব লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় সে সম্পর্কেও জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে।
অন্যদিকে, কিছু সমস্যা আছে যেগুলো কম খরচে কার্যকরভাবে সমাধানের উপায় আমরা জানি। চিকিৎসায় যক্ষ্মা সম্পূর্ণরূপে নিরাময়যোগ্য, অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সেটি হয়ে আসছে। তবুও এটি নীরব ঘাতক হিসেবে বছরে বিশ্বের দেড় লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। আবার, উন্নত দেশগুলোর প্রতি দশজনের নয়জন লিখতে-পড়তে পারলেও দরিদ্র দেশগুলোতে এই অনুপাত দশ জনে একজন। এছাড়া, প্রতি বছর ২০ লাখের বেশি নবজাতক ও তিন লক্ষাধিক নারীর মৃত্যু হয় প্রসবকালীন জটিলতায়। এসব সমস্যার সহজ এবং কার্যকর সমাধান রয়েছে।
এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মনোযোগে ঘাটতি রয়েছে।
এসডিজিতে অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার নির্দিষ্টকরণের জন্য বিগত বছরগুলোতে আমাদের বিশেষজ্ঞরা বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কাজ করেছেন। আমাদের সেই গবেষণা আগামী তিন মাসের মধ্যে ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত হবে। যেখানে এসডিজির কিছু সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্দেশিত হয়েছে।
সাফল্য তখনই আসবে যখন আমরা সৎ থাকব এবং অগ্রাধিকার নির্ধারণ করব। আসুন, উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতার পরিচয় মুছে আমরা বরং সেই প্রজন্ম হয়ে উঠি- যারা সবচেয়ে স্মার্ট জিনিসগুলোর প্রথম এবং সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে।
ড. বিওন লম্বোগ কোপেনহেগেন কনসেনসাসের প্রেসিডেন্ট এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির হুভার ইনস্টিটিউশনের ভিজিটিং ফেলো।
এই নিবন্ধ ঢাকা ট্রিবিউনের জন্য জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. বিওন লম্বোগের লেখা বিশেষ সিরিজের প্রথম অংশ।