দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৯ লাখ। বছরে এসব শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় ৭৪৩ টাকা। এসব কলেজের কোথাও কোথাও ১০০ জনের বিপরীতে একজন মাত্র শিক্ষকের অস্তিত্বের উদাহরণ এখন অনেক। আর সেই শিক্ষকও যদি ক্লাস নিতে অপারগ হন তাহলে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের আর কেউ-ই থাকে না।
বিষয়ভিত্তিক উদারহরণ আরও করুণতর। কিন্তু বছরে বছরে পরীক্ষা আসছে, তারা উত্তীর্ণ হচ্ছেন। কারণ খাতা দেখায় রয়েছে অবারিত উদারতা। এছাড়া উপায় কী। অকৃতকার্যরা আবার কলেজে থেকে যান, সামনের বছরে যেভাবেই হোক একটা সনদের আশায়। সেই সনদ পেয়ে কতজনের ভাগ্যে চাকরি জোটে।
২০২১ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপ বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলো থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের ৬৬% বেকার থাকছেন (দৈনিক প্রথম আলো)। আবার দেশের মোট উচ্চশিক্ষার্থীর ৬৬%-ই পড়ছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে। তাহলে!
শিক্ষা তো জাতির মেরুদণ্ড। আর এসবই হচ্ছে আমাদের সেই মেরুদণ্ডের খবর। আমাদের চলমান শিক্ষাব্যবস্থা বিপরীতভাবে বুঝিয়ে দিয়ে চলেছে, বিজ্ঞজনেরা অতীতে কেন বার বার এই মেরুদণ্ডের কথা বলে গেছেন।
সম্প্রতি প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে একটি কলেজে ইংরেজিতে অকৃতকার্য হয়েছেন ৬০% শিক্ষার্থী। পরিচিত হওয়ায় ওই কলেজের অধ্যক্ষকে প্রশ্ন করেছিলাম, ইংরেজির শিক্ষককে কী এরজন্য জবাবদিহি করতে হবে না। মহোদয় জানালেন, সুযোগ নেই। কারণ ওই দুই শিক্ষক দলীয়ভাবে প্রভাবশালী। ফলে অধ্যক্ষ আকার-ইঙ্গিতেও কিছু বলতে পারবেন না। অবশ্য তাদের অনুপস্থিতিতে অন্যরা এসব নিয়ে চুপি চুপি খুব সাবধানে সমালোচনা করেন এবং ভয়ে থাকেন কোনো না কোনোভাবে আবার তাদের কানে এইসব সমালোচনা পৌঁছে না যায়!
ওই ইংরেজির শিক্ষক যে সামান্য সংখ্যক ক্লাস নেন, সেখানে কীভাবে তারা পাঠদান করান সে কথা মনে এলেও তা ভয়ে হারিয়ে যায়। ফলে শিক্ষার্থীদের ভাগ্য এভাবেই ঝুলে থাকে সবসময়। এটি একটি কলেজের অবস্থা নয়, শত শত কলেজেও ঘটতে পারে।
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফুলপরীকে মনের মতো করে অকথ্য নির্যাতনের পর ছাত্রলীগ নেত্রী হল প্রাধ্যক্ষকে নির্দেশ দিলেন তাকে হল থেকে বের দিতে। সে মতো প্রাধ্যক্ষ করলেনও তাই। যিনি ওই আবাসিক ভবনের প্রধান, যার কাছে মা-বাবারা ভরসা করে তার সন্তানকে রেখে যান, তিনি ছাত্রলীগের সামান্যতম একজন নেতার কথাও ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না।
কতখানি অবিশ্বাস্য শোনায় জানি না, হল প্রাধ্যক্ষ একজন সিনিয়র অধ্যাপক এবং এই দায়িত্ব পালনের আগে তাকে হলের আবাসিক শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসতে হয়। তার অফিস কক্ষে একটি বিশেষ ছাত্র সংগঠনের নেতা প্রবেশ করলে তিনি চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে পড়েন! দুই দশক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই দেখেছি, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতা ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রক্টর অফিসে গেলে একজন সহকারী প্রক্টর চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে পড়তেন। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের অধ্যাপক ও পরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়েছিলেন এই যোগ্যতায়।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন এভাবে দাঁড়িয়ে পড়েন ওনারা। আলোচিত সময়েও এমন অনেক শিক্ষক বেঁচে আছেন যাদের দেখলে সবাই সমীহ করেন, শিক্ষককে শিক্ষকের মতোই মান্য করেন। এই দুই প্রকার শিক্ষকের মধ্যে আরো পার্থক্য তৈরি হয়েছে দিনে দিনে।
যেমন ধরুন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে খালি জায়গা দেখে ছাত্রনেতা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এখানে একটা ভবন নির্মাণ করতে হবে, মানে নতুন প্রজেক্ট আনতে হবে। সেটা হতে পারে নতুন লাইব্রেরি ভবন, মিলনায়তন, কোনো অনুষদের নতুন ভবন। এটা এখন আর অধ্যক্ষ বা উপাচার্যের মাথায় আসতে হয় না। আসে ছাত্রনেতার মাথায়। তিনি এটা চাপিয়ে দেন ভিসি বা প্রিন্সিপালের মাথায়। জানান, এভাবে এভাবে প্রজেক্ট করবেন স্যার। আমরা এটা পাশ করার ব্যাপারে আপনাকে হেল্প করব।
প্রতিষ্ঠান প্রধানকে সেই মতো কাজ করতে হয়। ঢাকায় গিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর ইউজিসিতে ঘুরতে হয়। সেখানে ছাত্রনেতারা তাদের নেতাদের দিয়ে কাজ এগিয়ে রাখেন। ভবনের কাজ শুরু হয় এক সময়।
আবার ধরুন উপজেলা শিক্ষা অফিসার পৌঁছানোর আগে, স্থানীয় জননেতা প্রাথমিকের শিক্ষক নিযোগের মৌখিক পরীক্ষা কখনো নিয়ে ফেলেন। শিক্ষা অফিসার স্কুলে পৌঁছে দেখলেন সব শেষ, খাওয়া-দাওয়া চলছে। তাকে বলা হলো, পরীক্ষা হয়ে গেছে। খামের ভেতরের কাগজে নতুন বা হবু শিক্ষকদের নাম লেখা আছে। প্রাথমিকের এই শিক্ষক ৩৫ বছর ধরে শিক্ষার্থীদের কী পড়াবেন বা পড়াতে পারবেন? এটা কে ভাববেন?
এসবকে কল্পকাহিনী ভাববেন নাকি বাস্তবতায় মেনে নেবেন এটা আপনার দৃষ্টিশক্তির প্রখরতা আর দৃষ্টিভঙ্গির বিশালতার ব্যাপার। অথচ এখনো এমন শিক্ষক-প্রশাসক আছেন যার কক্ষে ঢোকার আগে ছাত্রনেতাকে পাঁচ মিনিট হলেও বাইরে বসতে হয়। যদিও এই সংখ্যা শত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে হাতে গোনার চেয়েও কম হতে পারে। তবুও তো প্রদীপ জ্বলে আছে।
কেন এই আত্মসমর্পণ? আসলে কি এটা আত্মসমর্পণ? নাকি যে বা যারা যে পদের যোগ্য নন, যে কারণে ছাত্র দেখলেও চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে পড়ছেন, টিকে থাকতে ছাত্রের প্রয়োজনে প্রজেক্ট করছেন, তিনি বা তারা আসলে ভিন্ন উপায়ে সেই সব পদে বসে পড়েছেন। আর যাদের বসার কথা ছিল, দায়িত্ব নেয়ার কথা ছিল তারা উপেক্ষিত থেকেছেন। ২৫ বছর ধরে পেশাগত কারণে শিক্ষার দিকে দৃষ্টি ছিল আমাদের অনেকের। সেই দৃষ্টি ঝাপসা হওয়ার পথে।
ভিসির ভবনে না থেকে যে বাসায় ভাড়া থেকেছেন সেটি যে আপনার শ্বশুরের বাড়ি ছিল ৫ বা ১০ বছর পর জানাজানি হলেও তো কেমন। গেলেন গাড়িতে তুলে নিলেন প্লেনে যাতায়াতের ভাড়া, কেন হয় এটা? প্রতিষ্ঠান প্রধানের পদ প্রাপ্তির সাথে থাকে সমাজের সম্মান আর মযাদার আকাঙ্ক্ষা। বছর পার হলে সেখানে ঢুকে পড়ে আপনার অফিসের গাড়ির তেলের পরিমাণের প্রকৃত আর বিকৃত হিসেবের খবর। অতীতে যে শেষমেষ সবই বের হয়ে এসেছিল, সেটা মনে রাখবেন।
এসব কথা বলার কারণ সমালোচনা নয়। কারণ হলো যারা এসবের মধ্যে দিয়ে গেছেন বা যান তাদের বোঝানো যে মানুষ কিন্তু এসব জানে। তারা ভুলতে পারেন না, কষ্ট পান। নিয়োগকর্তাও প্রতারিত হন। যারা এই নোংরা পথে হাটেন শেষ বয়সে কী অর্জন তাদের। হিসেব করলে সেই হিসেব আসলে কতটুকু মেলে।
এমনিতেই নেই শিক্ষক। তারপরে যদি এ অবস্থা হয়-মানের, নৈতিকতায় এর অভিঘাত কী হবে আমাদের। আর কী হলে সন্তানদের জন্যে সামগ্রিকভাবে ভাবনার, কিছু করার দায় তৈরি হবে আমাদের?
বোরহানুল হক সম্রাট, সাংবাদিক
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত। ঢাকা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ এর জন্য দায়ী নয়।